অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ কি?
অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ একটি তীব্র ও গুরুতর সংক্রামক রোগ, যা ব্যাসিলাস অ্যান্থ্রাসিস (Bacillus anthrasis) নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে।

ব্যাসিলাস গণের অন্যান্য সদস্যের মতো অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু Bacillus anthracis-ও প্রতিকূল পরিবেশে রেণু (স্পোর) হিসাবে সুপ্ত অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে। সুপ্ত দশায় এই জীবাণু শতাব্দীর পর শতাব্দীও টিকে থাকতে পারে। নিঃশ্বাসের সাথে, ত্বকের ক্ষত দিয়ে, কিংবা খাদ্যের মাধ্যমে এই জীবাণুর রেণু দেহে প্রবেশ করার পরে পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।

এই জীবানু সাধারণত মানুষ থেকে পশুদের মধ্যে বেশী দেখতে পাওয়া যায়। অ্যানথ্রাক্স নামটি একটি গ্রীক শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ কয়লা। এই নামকরণটির কারণ হল অ্যানথ্রাক্স থেকে ত্বকে সত্যিই কালো দাগ সৃষ্টি হয়।

অ্যানথ্রাক্সের প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
উপসর্গগুলি অ্যানথ্রাক্সের ধরনের ওপর নির্ভর করে।
কিউটেনিয়াস বা ত্বক-সম্বন্ধীয় অ্যানথ্রাক্স হল যখন জীবাণু ত্বকের কাটা স্থান দিয়ে বা ক্ষত স্থান দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং পরবর্তীকালে কালো ঘা যুক্ত চুলকায় এমন ফোলা অংশের সৃষ্টি করে। এই ঘা হাতে, মাথায়, গলায় আর মুখে দেখা যায়। অনেকের মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি, পেশীতে ব্যাথা এবং জ্বর দেখা যায়।

গ্যাস্ট্রোইনটাস্টাইনাল অ্যানথ্রাক্স সংক্রমিত পশুর মাংস খেলে হয়। এর উপসর্গগুলি হল জ্বর আর খাদ্যের বিষক্রিয়া-এর জন্য বমি, অবস্থা আরো খারাপ হলে পেটে ব্যাথা, রক্ত বমি আর একটানা পেট খারাপ হতে পারে।

শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে জীবাণু শরীরে প্রবেশের মাধ্যমে যে অ্যানথ্রাক্স হয় তা সবথেকে ভয়ানক হতে পারে। প্রথম দিকের লক্ষণগুলি হল ঠাণ্ডা লাগা, সঙ্গে জ্বর, কাশি, অবসাদ, শরীরে যন্ত্রণা এবং মাথা ব্যথা, কিন্তু পরবর্তী কালে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং পক্ষাঘাত পর্যন্ত হতে পারে।

অ্যানথ্রাক্সের প্রধান কারণগুলি কি কি?
ব্যাসিলাস আন্থ্রাসিস নামক লম্বা রডের মতো দেখতে জীবাণুটিই সংক্রমণের প্রধান কারণ। এই ব্যাকটেরিয়াটি সুপ্ত দশায় অনেক বছর ধরে মাটিতে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় লুকিয়ে থাকতে পারে। এই জীবাণুটিকে সহজে ধ্বংস করা যায় না। এরা সাধারণত মানুষের থেকে বেশি চারণ পশুদের সংক্রমিত করে। মানুষের মধ্যে এই জীবাণু সাধারণত নিশ্বাসের মাধ্যমে, সংক্রামিত পশুর মাংস খেলে অথবা শরীরে কাটা বা ক্ষত স্থানের মাধ্যমে প্রবেশ করে। এই রোগের জীবানুর উন্মেষকাল কয়েক ঘন্টা থেকে সাত দিন পর্যন্ত হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্পর্শের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এই রোগ ঘটতে পারে। অ্যানথ্রাক্স প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে স্থানান্তরিত হতে পারে। মানুষ থেকে মানুষে অ্যানথ্রাক্স ছড়ায় না, কিন্তু মানুষের শরীর এবং পোশাক অ্যানথ্রাক্স জীবাণু বহন করতে পারে।

অ্যানথ্রাক্স রোগ নির্ণয়:
ডাক্তার রোগীর পূর্ব অসুস্থতার ইতিহাস আর তার পেশা সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করেন। উপসর্গের ওপর নির্ভর করে, ডাক্তার রোগ নির্ণয় করার জন্য রোগীর সংক্রমিত ত্বকের নমুনা, গলার মধ্যেকার তরলে ভেজা গজ বা থুতু সংগ্রহ আর সরাসরি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া আর অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করে দেখেন। এছাড়াও ডাক্তার বুকের এক্স-রে এর মাধ্যমেও রোগ নির্ণয় করতে পারেন, যাতে বুকের প্রসারণ ও ফুসফুসে তরলের উপস্থিতি দেখা যেতে পারে।

অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা:
ত্বকের সংক্রমণের ক্ষেত্রে রোগীকে বহিঃবিভাগেই চিকিৎসা দেওয়া যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের দ্বারা সব রকম অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা করা এবং পুরোপুরি সুস্থ্য হওয়া সম্ভব; রোগজীবাণু দ্বারা সৃষ্ট বিষক্রিয়া নষ্ট করার জন্য অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে অ্যান্টিটক্সিন বা প্রতিবিষ ব্যবহার করতে হবে। কখনো কখনো সরাসরি শিরায় প্রয়োগ করা হয় এমন অ্যান্টিবায়োটিকও ব্যবহার করা যেতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নির্ধারন ও গ্রহণ করা আবশ্যক।

শরীর থেকে জীবাণু দূর করার জন‍্য ব্যাকটেরিয়া নিরোধক সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে। গোসলের পানি ব্লিচ বা কোনও ব্যাকটেরিয়া নিরোধক দ্বারা শোধিত করতে হবে। জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত জিনিসপত্র ৩০ মিনিটের অধিক সময় ধরে ফুটাতে হবে। কোনো জায়াগা থেকে জীবাণু ধ্বংসে ক্লোরিন ব্লিচ কাযর্করী নয় বরং এক্ষেত্রে ফরমালডিহাইড ব‍্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত বাক্তির কাপড় পুড়িয়ে ফেলা জীবাণু ধ্বংসের একটি কাযর্কর পদ্ধতি। মানুষ আক্রান্ত হবার পর যত দ্রুত সম্ভব অ্যানথ্রাক্স জীবাণুনাশক দিতে হবে, যত দেরি হবে জীবনের ঝুঁকি তত বাড়বে।

অ্যানথ্রাক্সের জটিলতা:

  • চিকিৎসা না করলে চর্ম বা ত্বকের ক্ষেত্রে ২০% পর্যন্ত মারাত্মক হতে পারে।
  • গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল বা পাচননালী অ্যানথ্রাক্সে রক্তদূষণ, পক্ষাঘাত এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্সের ফলে ২৫% থেকে ৬০% লোকেদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
  • পালমোনারি বা ফুসফুসঘটিত অ্যানথ্রাক্সে গুরুতর শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, পক্ষাঘাত এবং প্রায়ই মেনিনজাইটিস (মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নাকান্ডের আচ্ছাদনে প্রদাহ) হতে পারে। পালমোনারি বা ফুসফুসঘটিত অ্যানথ্রাক্স সবসময় মারনকারী হয়।


অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে করণীয়:

  • মৃত পশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
  • রোগাক্রান্ত পশুকে জবাই করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।
  • রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে