অ্যাসাইটিস (পেটে পানি জমা) কি?
পেটের ভেতরে এক পর্দা আছে যার নাম পেরিটোনিয়াম। পেরিটোনিয়ামের দুটো স্তর—একটা স্তর পেটের ভেতরের দেওয়ালে লেগে থাকে, অন্য স্তরটা পেটের ভেতরকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে ঢেকে রাখে। পেরিটোনিয়াম থেকে এক তরল বেরোয় যার কাজ পেরিটোনিয়ামকে পিচ্ছিল রাখা যাতে এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের ওপর দিয়ে সহজেই পিছলে যেতে পারে। পেরিটোনিয়ামের এই দুই স্তরের মধ্যে যখন বেশি তরল জমে, সেই অবস্থাই হলো অ্যাসাইটিস।
সহজ ভাষায় অ্যাসাইটিসের অর্থ পেটের উপরি ত্বক ও পেটের ভিতরের অঙ্গসমূহের মধ্যবর্তী স্থানে পানি জমা। এই রোগ বিশেষত লিভারের সিরোসিসের (ক্ষত চিহ্নিত করা) সাথে জড়িত, যা লিভারের ভাইরাস সংক্রমণ বা মেদবহুল যকৃতের কারণে হয় এবং এর কারণ স্থূলত্ব এবং ডায়াবেটিস। ৭৫% রোগী যাদের সিরোসিস আছে তাদের অ্যাসাইটিসও দেখা দেয়।
বর্তমানে পেটের পানি বা অ্যাসাইটিস এর উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে এই পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
অ্যাসাইটিস বা পেটে পানি জমার মূল লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
অ্যাসাইটিসের উপসর্গগুলি তার কারণ অনুযায়ী ধীর ও তাৎক্ষণিক হতে পারে। যদি পানি জমার পরিমান কম হয় তবে বিশেষ কোন উপসর্গ নাও থাকতে পারে। পানি জমার পরিমান বেশী হলে শ্বাসকষ্টসহ আরো কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
অন্যান্য উপসর্গগুলো হল:
- পেটে ফোলাভাব বা ফেঁপে ওঠা।
- বুকে পানি জমা।
- ওজন বেড়ে যাওয়া।
- পেট ভার হয়ে থাকা।
- শরীর ফুলে যাওয়া।
- শরীর ভারী হয়ে যাওয়া।
- বমি বমি ভাব বা বদহজম।
- বমি করা।
- হাঁটুর নীচ থেকে ফুলে যাওয়া।
- পাইলস।
যদি অ্যাসাইটিসের সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয় তবে আরও অন্য যেসব রোগ হতে পারে:
- ব্যাক্টেরিয়াল পেরিটোনাইটিস।
- ডিলিউশনাল হাইপোনেট্রিমিয়া।
- হেপাটোরেনাল সিনড্রোম।
- আম্বিলিকাল হার্নিয়া।
পেটে পানি জমা বা অ্যাসাইটিসের মূল কারণগুলি কি কি?
অ্যাসাইটিস অনেকগুলি কারণের জন্য হতে পারে। আমাদের দেশে পেটে পানি জমার কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে:
- সিরোসিসঃ লিভারের সিরোসিসের রোগীরা সবচেয়ে বেশি যে লক্ষণ নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন তাহল অ্যাসাইটিস। অ্যাসাইটিস রোগীদের মোটামুটি ৭৫% এর সিরোসিস থাকে। আবার সিরোসিস রোগীদের প্রায় ৫০% এর বছর দশেকের মধ্যে অ্যাসাইটিস দেখা দেয়। লিভারের সিরোসিসে অন্তিমস্তরে পায়ে পানি জমা, ফুসফুসের আবরণীতে জমা জমা (প্লুরাল এফিউশন)ও দেখা যায়। সিরোসিসের রোগী অনেকদিন ধরে ভালো ছিলেন, হঠাৎ করে তাঁর অ্যাসাইটিস দেখা দিল, এমনটা হলে তাঁর লিভারের কোষের ক্যানসার (hepatocellular carcinoma) হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
- অ্যাসাইটিস-এর ১৫% রোগীর ক্যানসার পেটে পানি জমার কারণ। ক্যানসার হতে পারে পরিপাকতন্ত্রের, যেমন—পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার, লিভার কোষের ক্যানসার বা অন্য অঙ্গের ক্যানসার যা লিভারে বাসা বেঁধেছে। এছাড়া মহিলাদের ডিম্বাশয়ের ক্যানসার, লসিকাগ্রন্থির ক্যানসার, অন্যত্র থেকে পেটের গহ্বরে বাসা বাঁধা ক্যানসারও অ্যাসাইটিসের কারণ হতে পারে।
- হৃদযন্ত্রের বিকলতা বা হার্ট ফেলিওর
- নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম
- যক্ষ্মা
- প্যাঙ্ক্রিয়াটাইটিস বা অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ
- অন্যান্য দুর্লভ কারণগুলির মধ্যে আছে হাইপোথাইরয়েডিজম।
পেটে পানি এলে করণীয়:
- বাড়তি লবণ এবং লবণাক্ত খাবার পরিহার করতে হবে,
- দৈনিক পানি গ্রহণ ১ থেকে ১.৫ লিটারের বেশী নয়,
- অবশ্যই একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে,
- পেটে অত্যধিক, অস্বস্তিকর পানি থাকলে তা বের করে ফেলতে হবে,
- সাথে অ্যলবুমিনের ঘাটতি থাকলে অ্যালবুমিন ইনজেকশন দিতে হবে,
- রোগের কারণ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।
কিভাবে পেটে পানি জমা রোগ নির্ণয় হয়?
পেটের ফোলাভাবের পরিমাণ জানার জন্য প্রাথমিক ভাবে শারীরিক পরীক্ষা করা হয়।
- ফ্লুয়িড স্যামপ্লিং বা তরলের নমুনা সংগ্রহ।
- অ্যাসাইটিসের তরল পরীক্ষা: সূঁচ দিয়ে পেট ফুটো করে সিরিঞ্জ দিয়ে তরল টেনে বের করে, তরলকে বাষ্পীভূত করে দেখা হয় যে কোন সংক্রমণ বা ক্যান্সারের জীবাণু আছে কিনা।
- প্যারাসেনটেসিস পদ্ধতি ব্যবহার করে তরল নিষ্কাশন করা হয় পরীক্ষার জন্য।
- এম আর আই, সি টি, বা পেটের আল্ট্রাসাউন্ড।
লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা পরিমাপ করতে যে পরীক্ষাগুলি করা হয়:
- ২৪ ঘন্টা সময়কালের জন্য প্রস্রাব সংগ্রহ করা।
- ইলেক্ট্রোলাইটের পরিমাণ পরীক্ষা।
- কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা।
- লিভারের কার্যকারিতা পরীক্ষা।
- ক্লটিং স্ট্যাটাস বা জমাট বাঁধার অবস্থা।
অ্যাসাইটিস বা পেটে পানি জমা রোগের চিকিৎসা:
অ্যাসাইটিসের কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে তার চিকিৎসা করতে হয়।
- দিনে ৫.২ গ্রামের বেশি লবণ না খেলে সিরোসিসের কারণে অ্যাসাইটিস হলে ফল পাওয়া যায়।
- ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় স্পাইরোনোল্যাক্টোন, ফ্রুসেমাইডের মতো মূত্রবর্ধকগুলিকে।
- পেটে অ্যাসাইটিসের তরলে চাপ খুব বেড়ে শ্বাসকষ্ট হলে সূঁচ ফুটিয়ে তরল বার করে দেওয়াও চিকিৎসার অঙ্গ।
- কখনও কখনও অপারেশন করে অ্যাসাইটিসের তরল রক্ত-প্রবাহে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা বা শান্ট করা হয়।
অ্যাসাইটিসের জটিলতা:
- মূত্রবর্ধক দিয়ে অ্যাসাইটিসের চিকিৎসা চলাকালীন রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যেতে পারে।
- আপনা থেকে পেরিটোনিয়াল গহ্বরের ব্যাক্টেরয়া-ঘটিত প্রদাহ হতে পারে অনেকের।
অ্যাসাইটিস রোগীর ভবিষ্যত:
- যে সব সিরোসিস রোগীর অ্যাসাইটিস হয়, তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৫% এক বছরের মধ্যে মারা যান, পাঁচ বছর বেঁচে থাকেন ৪৪%।
- ক্যানসারের কারণে অ্যাসাইটিস হওয়ার মানে রোগ বেশ ছড়িয়েছে, এঁদের ভবিষ্যৎ ভালো নয়।