বিছানায় প্রস্রাব করা (বেড ওয়েটিং) কি?
বেড ওয়েটিং, সমস্যাটি রাত্রিবেলা ঘুমের মধ্যে প্রস্রাব হয়ে যাওয়া বা বিছানা ভেজানো হিসেবেও পরিচিত। এটি ঘুমের মধ্যে প্রস্রাবের একটি অনিচ্ছাকৃত পুনরাবৃত্তিমূলক ধরণ। এই সমস্যা সাধারণত, প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর বয়সের পর আর হয় না। সারা বিশ্বের স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের মধ্যেই এই সমস্যাটা দেখা যায়। যদিও বাচ্চাদের এবং কিশোরদের মধ্যে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলাটা সাধারণ ব্যাপার।

বড় শিশুরা বিছানা ভেজালে শিশু ও তার পিতা-মাতা উভয়ের জন্যই বিব্রতকর। বিছানা ভেজানোর ফলে শিশুর আত্মবিশ্বাসও কমে যায়। এ ছাড়া শিশু স্কুলগামী হলে বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। অনেক সময় বিছানা ভেজানোর সমস্যার কারণে শিশু কোথাও যেতে চায় না বা গেলেও কোনোভাবেই রাতে থাকতে চায় না।

নিজেকে আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে রাখে। ফলে সামাজিকীকরণে শিশু পিছিয়ে পড়ে। অন্যদিকে বিছানা ভেজানোর সমস্যা কমানোর জন্য অনেক মা-বাবা শিশুকে বকাঝকা বা শারীরিকভাবে শাস্তি দেন। যার ফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক হয়। তাই শিশুকে বকাঝকা বা মারধর না করে শিশু কিভাবে প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তা শেখানো প্রয়োজন।

বিছানায় প্রস্রাব করার প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো কি কি?
সাধারণত, শিশুরা ৫ বছর বয়সের মধ্যেই টয়লেট ব্যবহার করতে শিখে যায়। তবে, মূত্রথলির ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আয়ত্ত করার কোনও নির্দিষ্ট বয়স নেই। কিছু কিছু বাচ্চা ৫ থেকে ৭ বছর বয়সের মধ্যে এই সমস্যায় পড়তে পারে। তবে যেসব উপসর্গ এবং লক্ষণের ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে, সেগুলো হল:

  • ৭ বছর বয়সের পরেও বাচ্চা বিছানায় প্রস্রাব করলে।
  • রাত্রে বিছানায় কয়েক মাস প্রস্রাব করা বন্ধ থাকার পর আবার শুরু।
  • ঘুমের মধ্যে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার পাশাপাশি প্রস্রাবের সময় যন্ত্রণা অনুভব, প্রস্রাবের রঙ গোলাপি বা লাল, অত্যধিক তৃষ্ণা, মল শক্ত বের হওয়া অথবা নাক ডাকা।


বিছানায় প্রস্রাব করার প্রধান কারণ কি?
বিছানায় প্রস্রাব করার সঠিক কারণ নিয়ে এখনো কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই, কিন্তু নিম্নলিখিত ব্যাপারগুলি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে:
ছোটো মূত্রথলি: মূত্রাশয় সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি।

  • মূত্রথলি ভরে উঠেছে, তা বুঝে উঠতে না পারা: মূত্রথলি ভরে উঠলেও, সংশ্লিষ্ট শিশুটিকে তার মূত্রথলি জাগিয়ে তুলতে পারে না, কারণ মূত্রথলিকে যে স্নায়ুগুলি নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলি স্বাভাবিক গতিতে পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি।
  • হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা: কিছু মানুষের অ্যান্টিডাইইউরেটিক হরমোন (এডিএইচ) কম থাকতে পারে, যার ফলে রাতে প্রস্রাব কম মাত্রায় তৈরি হয়।
  • মূত্রনালীর সংক্রমণ: সংক্রমণের কারণে শিশুর প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা হতে পারে।
  • স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাঘাত: ঘুমের সময় শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হতে পারে টনসিল অথবা অ্যাডিনয়েডের প্রদাহজনিত সমস্যা অথবা ফুলে উঠলে।
  • ডায়াবেটিস: সাধারণত, আপনার সন্তানের শরীর যদি রাতে শুকিয়ে ওঠে, তাহলে বিছানায় ঘুমের মধ্যে প্রস্রাব করা ডায়াবেটিসের প্রথম লক্ষণ হতে পারে।
  • দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য: দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য মাংসপেশীর কার্যকারিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যেগুলি উভয় প্রস্রাব এবং মলত্যাগকে নিয়ন্ত্রণ করে।
  • মানসিক চাপ: ভয়-প্ররোচিত মানসিক চাপ বিছানায় প্রস্রাব করার কারণ হতে পারে।


কখন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে হবে?

  • শিশু যদি ৭ বছর বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব করে।
  • রাতে কয়েক মাস শুকিয়ে যাওয়ার পরে নতুনভাবে বিছানা ভেজাতে শুরু করে।
  • বিছানা ভেজার সঙ্গে বেদনাদায়ক মূত্রত্যাগ, অস্বাভাবিক তৃষ্ণা, গোলাপি বা লাল প্রস্রাব, শক্ত মল, বা কৌষ্ঠকাঠিন্য।


বিছানায় প্রস্রাব করা কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
চিকিৎসক সন্তানের প্রস্রাবের রুটিনের ওপর নজর রাখার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন এবং প্রয়োজনে ডায়েরিতে লিখে রাখা দরকার হতে পারে।

উল্লেখ্য বিষয়গুলি হল:

  • কতবার প্রস্রাব হচ্ছে
  • মলত্যাগ কতবার হচ্ছে এবং তার ধারাবাহিকতা
  • শুতে যাওয়ার সময় পানি পান করা।


যে পরীক্ষাগুলো চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:

  • মূত্রের ধরণ এবং বিশ্লেষণ: সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, মূত্রে রক্তের বা অন্য কোন পদার্থের থাকার নমুনা পরীক্ষা করা।
  • রক্ত পরীক্ষা: অ্যানিমিয়া, ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা এবং অন্যান্য অবস্থার জন্য পরীক্ষা করা।
  • মূত্রাশয়ের আল্ট্রাসাউন্ড: প্রস্রাবের পরে মূত্রাশয়তে কতটা পরিমাণ প্রস্রাব থাকছে, তা জানার জন্য পরীক্ষা।
  • ইউরোডাইনামিক পরীক্ষা: প্রস্রাব কিভাবে জমা হচ্ছে এবং বের হচ্ছে, তা পরীক্ষা করে দেখা হয় এর মাধ্যমে।
  • সিস্টোস্কপি: মূত্রাশয়ে ক্যামেরা প্রবেশ করিয়ে দেখা হয়, মূত্রাশয় কিরকম অবস্থায় রয়েছে।


বিছানায় প্রস্রাব করা খুব একটা বড় সমস্যা নয়, কারণ এটি একটি শিশুর বেড়ে ওঠার পর্যায়কে নির্দেশ করে। তবে, এর ফলে শিশুরা বিব্রত এবং আত্মসম্মানহানি বোধ করতে পারে। বাবা-মায়েরাও এই পরিস্থিতির সংশোধন করতে নিজেকে অসহায় বোধ করতে পারেন।

এই ধরণের পরিস্থিতি যেভাবে সামলাতে হয়:
বাচ্চাদের মধ্যে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কী করবেন আর কী করবেন না? জেনে নিন:

  • দিনের বেলা বাচ্চাকে বেশি করে তরল পানীয় খাওয়ান।
  • সারাদিনে বাচ্চা যেন ৫-৭ বার টয়লেটে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
  • রাতে ঘুমনোর ঠিক আগে যেন সে টয়লেট করে।
  • রাতে ঘুম ভেঙে গেলে যাতে সহজেই টয়লেট করতে পারে, তার ব্যবস্থা রাখুন।
  • বিছানার ওপর ওয়াটারপ্র‌ুফ কভার পেতে রাখুন।
  • বাচ্চা বিছানা ভিজিয়ে তাকে বকাবকি করবেন না বা শাস্তি দেবেন। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
  • সন্তানকে ক্যাফেইন রয়েছে এমন কোনও পানীয় দেবেন না। যেমন কোক, চা বা কফি। এগুলি খেলে বেশি ইউরিন হয়।
  • সন্তানের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করুন যে তার মনের মধ্যে কোনও ভয় বা অস্বস্তি বাসা বেধে আছে কিনা। মানসিক কারণেও রাতে সে বিছানা ভিজিয়ে ফেলতে পারে।


ওষুধ:
কখনো কখনো শেষ অবলম্বন হিসাবে বিছানা ভেজানো বন্ধ করতে অল্প সময়ের জন্য ওষুধ প্রয়োজন হয়। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আছে-

  • অ্যান্টিকোলিনেরজিক ওষুধ। অ্যান্টিকোলিনেরজিক ড্রাগ মূত্রাশয়ের সংকোচনের পরিমাণ হ্রাস করতে এবং মূত্রাশয়ের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, বিশেষত যদি দিনের বেলাও ভিজে যায়। এই ওষুধটি অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে সাধারণত ব্যবহৃত হয় এবং অন্যান্য চিকিৎসা ব্যর্থ হলে সাধারণত দেওয়া হয়।
  • ইমিপেরামিন ও ডেসমোপেরেসিন ওষুধ দুটো তাৎক্ষণিকভাবে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রকোপ কমিয়ে দিতে পারে, তবে পরে পুনরায় সমস্যা আবার ফিরে আসে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তবে অল্প সময়ের জন্য কোনো ক্যাম্প বা বন্ধুদের সঙ্গে কোনো ভ্রমণ বা ছুটি কাটাতে ওষুধ দুটো ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • রাতে প্রস্রাব উৎপাদন ধীরকরণ। Desmopressin (DDAVP) রাতে প্রস্রাব উৎপাদন হ্রাস করে। ডেসমোপ্রেসিনকে মুখে ট্যাবলেট হিসাবে দেওয়া হয় এবং এটি কেবল ৫ বছরের বেশি বয়সি বাচ্চাদের জন্য। ভাসোপ্রেসিন হরমোন, যা বারংবার প্রস্রাব করার প্রবণতা বা প্রস্রাবের পুনরাবৃত্তির হার (Frequency rate) এবং পরিমাণ হ্রাস করে। এটি প্রস্রাব করার তাগিদ হ্রাস করতে এবং সাধারণ জীবনধারণে সহায়তা করে। ওষুধ থেকে সর্বাধিক উপকার পেতে নিয়মিত এটি ব্যবহার করতে হয়। তবে ওষুধের সঙ্গে অত্যধিক পানি পান করলে সমস্যার সমাধান হবে না। যদি ১৬ সপ্তাহের চিকিৎসায় ১৪ দিন শুকনো থাকে তবে মনে করা যেতে পারে, সে প্রাথমিক শুকনো রাখার প্রক্রিয়ায় সাড়া দিচ্ছে। আর যদি ২ বছর পর্যন্ত সে অব্যাহতভাবে শুকনো প্রক্রিয়া থাকে, তাহলে সারা জীবনের জন্য সে সুস্থ হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।


*কোনো ওষুধই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা উচিত নয়।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে