মারুফের (ছদ্মনাম) বয়স ২৬ বছর। পড়ালেখা শেষ করে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছেন। ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে কথা বেশি বলছে। রাতে ঘুমাচ্ছে না। ইচ্ছামতো টাকাপয়সা খরচ করছে। দরকারি-অদরকারি জিনিস কেনাকাটা করছে। বন্ধুবান্ধবদের খাওয়াচ্ছে। নিজেকে বড় মনে করছে আর রাস্তাঘাটে প্রায়ই বচসা ও মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে। অবস্থা দেখে তার বাবা-মা মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। চিকিৎসক জানালেন তুষারের রোগের নাম বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার (বিএমডি)। রোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে তিনি তুষারকে ওষুধ দিলেন।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার কাকে বলে?
কখনো খুবই আনন্দিত, আবার কখনো খুবই বিষণ্ণ। সহজ ভাষায় বলতে, দীর্ঘসময় ধরে একজন ব্যক্তির মুডের, আবেগের বা মানসিক অবস্থার বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটতে থাকলে তাকে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলে বর্ণনা করে থাকেন চিকিৎসকরা।

অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনো কখনো দীর্ঘসময় ধরে বিষণ্ণতা বা মন খারাপের মধ্যে থাকেন। কখনো কখনো সেটা কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে। আবার একই ব্যক্তি একসময় সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ করতে শুরু করেন। সেই সময় তিনি অতিরিক্ত হাসিখুশি বা উচ্ছ্বাস প্রবণ হয়ে ওঠেন।

ডায়াবেটিসের মতো বাইপোলার ডিসঅর্ডার একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ। ওষুধ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তবে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যায় না।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
বাইপোলারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেহেতু দুই ধরনের মুড বা আচরণ প্রকাশ করেন, তাই এর লক্ষণও দুই প্রকার বলা যায়। একই ব্যক্তির মধ্যে সময়ের ব্যবধানে এরকম পরস্পর বিপরীত আচরণ দেখা গেলে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

ম্যানিয়া এপিসোড:

  • অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ, অতি উৎফুল্ল মনোভাব
  • অতিরিক্ত কথা বলা
  • নিজেকে বিশাল শক্তিশালী, বড় কেউ, ক্ষমতাশালী মনে করতে শুরু করা
  • হাই এনার্জি বা অতিরিক্ত কাজের প্রবণতা
  • খাবারে অনীহা
  • অযৌক্তিক কথা বা দাবি করা, চিন্তাভাবনা করা
  • বাড়তি উচ্ছ্বাস প্রবণতা
  • নিদ্রাহীনতা, ঘুম এলেও ঘুমাতে না চাওয়া
  • হঠাৎ রেগে যাওয়া, ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারি করা
  • বেপরোয়া মনোভাব
  • বেশি বেশি খরচ করতে শুরু করা, অদরকারি জিনিসপত্র কিনতে চাওয়া
  • মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
  • যৌন-স্পৃহা বেড়ে যাওয়া
  • নিজের জিনিসপত্র অন্যদের বিলিয়ে দেয়া
  • মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শে বাইপোলার ডিসঅর্ডার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়
  • ছবির ক্যাপশান,
  • মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শে বাইপোলার ডিসঅর্ডার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়


ডিপ্রেশন ডিজঅর্ডার:

  • ম্যানিয়া ডিসঅর্ডারের ঠিক বিপরীত হচ্ছে ডিপ্রেশন ডিসঅর্ডার। একই ব্যক্তি পরস্পর বিপরীতমুখী এধরনের মানসিক পরিবর্তনে ভোগেন বলেই বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলা হয়।
  • দীর্ঘসময় বা দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকা, হতাশায় ভোগা
  • বিনা কারণে কান্নাকাটি করা, উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠা
  • আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা
  • নিজেকে ক্ষুদ্র, তুচ্ছ বলে মনে করা
  • আত্মহত্যার প্রবণতা, জীবন সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মরে যেতে চাওয়া
  • কোন ঘটনাতেই আনন্দ বা খুশী হতে না পারা
  • খাবারের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা বা অতিরিক্ত খাবার খাওয়া
  • অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ, কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
  • অপরাধ বোধ, নিজেকে দোষী ভাবা
  • যৌন-স্পৃহা কমে যাওয়া
  • স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
  • খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া


বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রধান কারণগুলি কি কি?
বাইপোলার ডিসঅর্ডার ঠিক কোন কারণে হয়, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এর পেছনে কয়েকটি উপাদান কাজ করে থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন।

  • মস্তিষ্কের গঠনগত কারণকে এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়।
  • যদি রোগীর বাবা-মা বা দাদা-দাদীর বাইপোলার ডিসঅর্ডার থাকে, তাদের সন্তানদেরও এই রোগ হবার উচ্চ-সম্ভাবনা থেকে যায়।


অন্যান্য যে কারণগুলি বাইপোলার ডিসঅর্ডারের জন্য দায়ী সেগুলি হল, খুব বেশি মানসিক চাপ, মানসিক আঘাত অথবা শারীরিক কোনও অসুস্থতা থেকেও হতে পারে।

কিভাবে এর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করা কঠিন, কারণ এর নির্দিষ্ট কোনও শারীরিক উপসর্গ নেই এবং যেহেতু ভিন্ন ব্যক্তির মেজাজ ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়।

  • মানসিক রোগের চিকিৎসক বিভিন্ন রকমের ক্রিয়াকলাপ ও কাজের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ পরীক্ষা করে দেখেন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর প্রাত্যহিক ভাবে লিখে রাখা মেজাজ সম্পর্কিত দিনলিপিও যথেষ্ট সাহায্য করে।
  • কিছু মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরীক্ষা আছে, যার মাধ্যমে মানসিক অবস্থার উপসর্গগুলি বিচার করে বাইপোলার ডিসঅর্ডার রয়েছে কিনা বোঝা যায়।
  • ডাক্তার অন্যান্য অসুখের সম্ভাবনা সম্বন্ধে পরিষ্কার হয়ে নেওয়ার জন্য এর সাথেই কিছু শারীরিক পরীক্ষা এবং কিছু রকমের রক্ত পরীক্ষা করেন।


বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি চিকিৎসায় ভালো হয়?
বাইপোলার ডিজ়অর্ডার দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এই রোগে আক্রান্ত হলেই সব শেষ হয়ে গেল, আর সারবে না। অনেকের ক্ষেত্রেই নিয়মিত ওষুধ খেলে রোগকে ভালমতো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্বাভাবিক জীবনযাপনেও কোনও সমস্যা থাকে না। তবে, নিয়মিত চিকিৎসা এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। ওষুধ খাওয়ার পরেও কোনও ক্ষেত্রে রোগ মাথাচাড়া দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকই প্রয়োজন বুঝে ওষুধ পাল্টে দেবেন। কিন্তু নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া বা চিকিৎসা কোনও ভাবেই বন্ধ করা চলবে না। চিকিৎসকের কথাই শেষ কথা।

চিকিৎসকের দেয়া ওষুধ এবং পরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে থাকলে এই রোগটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে তিনি বলছেন।

অভিভাবকদের করণীয়:

  • বাইপোলারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে অযথা তর্কে জড়াবেন না।
  • তাকে অপরাধী মনে করবেন না, উত্ত্যক্ত করবেন না। তার কোনো আচরণের জন্য দায়ী করে মারধর করবেন না।
  • দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। মনে রাখবেন বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার একটি সাইকোসিস ঘরানার রোগ, যার মূল চিকিৎসা হচ্ছে নিয়মিত ওষুধ সেবন। কোনো প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে ওষুধকে ভয় পাবেন না।
  • এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির কেনাকাটা, ব্যাংকের কাগজ, ক্রেডিট কার্ড, জমি ও বাড়ির দলিল অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে রাখুন। কারণ এ সময় অযৌক্তিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা রয়েছে।
  • মনে রাখবেন বিয়ে এই সমস্যার চিকিৎসা নয়। তাই সমস্যাটিকে নিয়ন্ত্রণ না করে বিয়ে দেবেন না।
  • সতর্ক নজরদারিতে রাখুন। এ সময় সে আত্মহত্যাসহ নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে যেতে পারে। তার সব ওষুধ অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে রাখুন।
  • মাদক সেবন থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকুন। মাদক তার লক্ষণগুলোকে আরও বাড়াবে।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে