বার্ড ফ্লু কি?
বার্ড ফ্লু, ডাক্তারি মতে যাকে পক্ষী বা পাখি দ্বারা সংক্রামিত ইনফ্লুয়েঞ্জা বলা হয়, যেটি মানুষের মধ্যে বিরল একটি সংক্রামক রোগ। বার্ড ফ্লু হল এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা। ভাইরাসঘটিত এই রোগটি বন্য জলচর পাখিদের প্রাকৃতিকভাবেই সংক্রমিত করে এবং কখনও কখনও গৃহপালিত পশু-পাখিদেরকেও সংক্রমিত করতে পারে। যদিও পক্ষী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পাখিতে অভিযোজিত, এটি মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে। বার্ড ফ্লু সংক্রামিত ব্যক্তির মধ্যে ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায় এবং তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এটি অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যাভিয়ান ফ্লু, বার্ড ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি নামে পরিচিত। বিভিন্ন প্রকারের বার্ড ফ্লু আছে, যাদের মধ্যে অধিক রোগসৃষ্টিকারী বার্ড ফ্লু (ইংরেজি Highly Pathogenic Avian Influenza (HPAI)) সবচেয়ে বিপজ্জনক, যেটি বাংলাদেশে প্রথম দেখা যায় দুই হাজার সাত সালে।

বার্ড ফ্লুর প্রকারভেদ:
তিন ধরনের (এ, বি ও সি) ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা এ একটি পশুপাখিবাহী রোগ (বা জুনোটিক সংক্রমণ, ইংরেজিতে Zoonotic infection) যার প্রধান প্রাকৃতিক ধারক (Natural reservoir) হল পাখি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বার্ড ফ্লু বলতে ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাসকেই বোঝায়। রোগসৃষ্টিকারী ক্ষমতার (প্যাথজেনিসিটি) উপর ভিত্তি করে বার্ড ফ্লুকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়-

  • অধিক রোগসৃষ্টিকারী (HPAI) এবং
  • স্বল্প রোগসৃষ্টিকারী (LPAI) বার্ড ফ্লু।


এইচ.পি.এ.আই (HPAI)-এর বহুল পরিচিত স্ট্রেইন এইচ৫এন১ (H5N1) সর্বপ্রথম আলাদা করা হয় চীনের কুয়াংতুং প্রদেশে একটি খামারের হাঁস থেকে।

বার্ড ফ্লুর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
বার্ড ফ্লুর লক্ষণগুলি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই। এর সাধারণ উপসর্গুলি হলো:

  • এ ভাইরাস সংক্রমণের পর রোগীর দেহে প্রাথমিকভাবে জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
  • জ্বরের পাশাপাশি শরীর ব্যথা, ঠান্ডা লাগা, হাঁচি, কাশি, মাথা ব্যথা, মাংসপেশী ব্যথা, বমি, পেট খারাপ- এ ধরনের উপসর্গ থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে এ লক্ষণ খুব বেশি দেখা যায়। মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকতে পারে।
  • অনেক সময় ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে মারাত্মক নিউমোনিয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রচণ্ড কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং এআরডিএস অর্থাৎ অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেসের ঝুঁকি থাকে।
  • এর থেকে এনসেফেলাইটিস, হৃদপিণ্ডের সংক্রমণ, মায়োসাইটিস হয়।


অনেক সময়, বার্ড ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে বমি বমি ভাব ও বমি করার প্রবণতা থাকে। অপরদিকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য কোনো উপসর্গ ছাড়া শুধুই চোখে সংক্রমণ থাকতে পারে।

বার্ড ফ্লুর প্রধান কারণগুলি গুলি কি কি?
বার্ড ফ্লু ভাইরাস দুই রকমের হয়, মানুষের মধ্যে সাধারণত এইচ৫এন১ ভাইরাস দেখা যায়। পাখির মাধ্যমেই এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয় এবং তা নিম্নোক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে:

  • পোল্ট্রির কাজের মাধ্যমে
  • খোলা বাজারে যেখানে পাখির ডিম ও পোল্ট্রিদ্রব্য বিক্রি হয় সেখানে শ্বাসপ্রশ্বাসের ফলে হতে পারে
  • সংক্রামিত পাখি স্পর্শ করার ফলে
  • সংক্রামিত পাখির বিষ্ঠা যে পানিতে ফেলা হয় সেই পানিতে গোসল করলে
  • ভালোভাবে সিদ্ধ না করা সংক্রামিত পাখির ডিম এবং মাংস সংক্রমণ ছড়াতে পারে। সম্পূর্ণ ভাবে রান্না করা পাখির ডিম ও মাংস মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়।


কিভাবে বার্ড ফ্লু নিৰ্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
বার্ড ফ্লুর সংক্রমন সাধারণ পদ্ধতিতে গবেষণাগারে নির্ণয় করা হয় যদিও সব গবেষণাগারে এটির যে নির্দিষ্ট পরীক্ষা গুলি আছে সেগুলি করা হয় না।

  • নাক ও গলা থেকে সংগৃহীত তরল পদার্থের মধ্যে ভাইরাস আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়।
  • একটি সম্পূর্ণ ব্লাড কাউন্ট বা রক্তকোষ গণনার মাধ্যমে শরীরে সংক্রমন আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়।
  • ফুসফুসের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে বুকের এক্স-রে করা হয়।


বার্ড ফ্লুর যথাযথ চিকিৎসার জন্য অ্যান্টি-ভাইরাল বা সংক্রামক রোগাদির বীজনাশক ওষুধ দেওয়া হয়।

  • উপসর্গ গুলি চোখে পড়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওষুধগুলো সেবন করা খুবই জরুরী।
  • সংক্রামিত ব্যক্তির দেহে যে ভাইরাসগুলি থাকে সেগুলি সাধারণত যে অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ দেওয়া হয় তাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে, তাই বিকল্প ওষুধের বিধান দিতে হয় ডাক্তারকে।
  • সতর্কতা হিসাবে, রোগীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের শরীরে এই ভাইরাস আছে কিনা তার পরীক্ষা করা হয় এবং যেখানে এই সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়।
  • কোন কোন ক্ষেত্রে, রোগীকে আলাদা করে রাখা হয় যাতে সংক্রমণ ছড়াবার কোনো সম্ভাবনা না থাকে।


বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে করনীয়:
এটি ভাইরাসজনিত একটি ছোঁয়াচে রোগ। নিম্নলিখিত বিষয় সমুহ মেনে চললে এবং একটু সতর্ক হলে বার্ডফ্লু প্রতিরোধ করা সম্ভব। যথা-

  • খালি হাতে অসুস্থ্য বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এমন হাঁস বা মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরা বা নাড়াচাড়া করা যাবে না।
  • অসুস্থ হাঁস, মুরগি জবাই করা বা পালক ছাড়ানো অথবা নাড়াচাড়া করা যাবে না।
  • অসুস্থ হাঁস, মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরা এবং সেগুলো নিয়ে খেলাধুলা করা থেকে শিশুদের বিরত রাখতে হবে।
  • আক্রান্ত পাখিদের বিষ্ঠায় অতিরিক্ত পরিমানে এই ভাইরাস পাওয়া যায়। তাই যারা ঘরে পাখি পালন করেন তাদের ঘরে পাখির বিষ্ঠার মাধ্যমে শিশু ও বড়দের মধ্যে জীবাণু সংক্রমনের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
  • হাঁস, মুরগি বা পশুপাখি ধরার পর ভালো করে সাবান বা ছাই এবং পানি দিয়ে দুই হাত ভালভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
  • হাঁস, মুরগি বা পশুপাখির ঘরে কাজ করার ক্ষেত্রে, কাপড় দিয়ে নাক ও মুখ ভালভাবে ঢেকে নিতে হবে। পশুপাখি নাড়াচাড়ার পর হাত না ধুয়ে চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করা যাবে না।
  • হাঁস, মুরগির মাংস ভালোভাবে সেদ্ধ করে রান্না করতে হবে। আধা সেদ্ধ মাংস, ডিম বা মাংসের তৈরি খাবার খেলে সংক্রমনের সম্ভাবনা থাকে।
  • বার্ড ফ্লু আক্রান্ত এলাকা অর্থাৎ যেখানে এ রোগ ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এমন স্থানে বা তার আশপাশে যারা বাস করেন, তাদের হাঁস, মুরগি বা অন্যান্য পাখি ক্রয় বিক্রয় বা জবাই করার স্থান থেকে দূরে থাকতে হবে।
  • অসুস্থ হাঁস, মুরগি বা অন্যান্য পাখির মল সার অথবা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
  • মৃত হাঁস, মুরগি এবং পাখি মাটিতে পুঁতে ফেলার সময় অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • হাঁস, মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরার পর যদি কেউ জ্বর, সর্দি কিংবা কাশি জাতীয় কোনো রোগে ভোগেন, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং অবশ্যই রোগে আক্রান্ত বা মৃত হাঁস, মুরগির সংস্পর্শে আসার বিষয়টি চিকিৎসককে জানাতে হবে।
  • এ রোগটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর একমাত্র মাধ্যম হলো হাঁচি বা কাশি থেকে নির্গত ড্রপলেট। তাই আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখলে এর সংক্রমন থেকে নিরাপদে থাকা যেতে পারে।
  • আবার আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কিংবা কাশি থেকে নির্গত ড্রপলেট, নিত্য ব্যবহার্য্য কোন স্থানে বা পাত্রে লেগে থেকেও সংক্রমন ঘটাতে পারে। যেমন- মোবাইল, রিমোট, টেলিফোন, টেবিল, চেয়ার, দরজার হাতল ইত্যাদি একজন সুস্থ্য ব্যক্তি হাত দিয়ে স্পর্শ করলে এবং ওই হাত দিয়ে তার নাক, মুখ বা চোখ স্পর্শ করলে, তা থেকে সুস্থ্য ব্যক্তির বার্ডফ্লু হতে পারে।
  • জনসমাগম বেশী এরুপ স্থানে, কারও না কারও এই রোগ থাকতেই পারে তাই ওই সকল স্থানের কোনো কিছু স্পর্শ করে সাথে সাথে নাক, মুখ বা চোখ স্পর্শ করা যাবে না।
  • সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে নিলেও হাতে বার্ড ফ্লুর ভাইরাস থাকে না। এজন্য যাদের অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় তারা দিনে বেশ কয়েকবার ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিরাপদে থাকতে পারেন।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে