শরীরে ব্যথা (গায়ে ব্যথা) কি?
শরীর ব্যথা হচ্ছে বিভিন্ন রোগের একটি সাধারণ উপসর্গ। শরীরের ব্যথা হল সারা শরীরের একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি যা আপনাকে ক্লান্ত এবং অলস উপলব্ধি করায়। এটা হঠাৎ বা কখনো কখনো হতে পারে, এমনকি ধীরে ধীরে এবং একসঙ্গে অনেক দিন ধরেও হয়। এই ধরণের ব্যথা টেন্ডন বা লিগামেন্টগুলির মত নরম টিস্যুতে বা বিভিন্ন পেশীতে অনুভূত হতে পারে। কখনো কখনো, এটি একটি অন্তর্নিহিত গুরুতর রোগকে নির্দেশ করে, যদিও কখনো কখনো, এটি উদ্বেগ এর মত মানসিক সমস্যার অভিব্যক্তিও হতে পারে। বেশ পরিচিত রোগ ফ্লু শরীরে ব্যথার উদ্রেক করতে পারে। প্রতিদিনকার কার্যপ্রণালীর কারনেও শরীর ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটলে, দাঁড়ালে বা অনুশীলন করলে।

শরীরে ব্যথার সঙ্গে যুক্ত প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো কি কি?
শারীরিক ব্যথা অ্যাকিউট বা ক্রনিক হতে পারে, তবে কম বেশি, এটা একধরনের উপসর্গগুলো নিয়েই আসে; অ্যাকিউট (কয়েক দিনের জন্য স্থায়ী) বা ক্রনিক (এক মাস ধরে স্থায়ী)। উভয় ধরনের কারণ ভিন্ন ভিন্ন হয়।

শরীরের ব্যথার সঙ্গে যুক্ত উপসর্গগুলি হল:

  • শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বা এলাকায় ব্যথা।
  • টেন্ডার পয়েন্ট (এই জায়গাগুলো টিপলে ব্যথার বৃদ্ধি অনুভূত হয়)।
  • অবসাদ
  • ভালো ঘুম না হওয়া, সকালে জেগে উঠার পরও সতেজ না হওয়া।
  • মর্নিং স্টিফনেস (এটি ৩০ মিনিটের মতো স্থায়ী হয়)।
  • হাত, পা, বাহু ইত্যাদিতে ঝিঁঝি এবং অসাড় অবস্থা।
  • মাথা ব্যথা
  • উদ্বেগ


শরীরের ব্যথার প্রধান কারণগুলো কি কি?
অ্যাকিউট শরীরের ব্যথার কারণগুলো হল:

  • দৈহিক অসুস্থতা অথবা আঘাত
  • জলশূণ্যতা
  • হাইপোকালেমিয়া (কম পটাসিয়ামের মাত্রা)
  • ঘুমের অভাব
  • তীব্র ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ
  • অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম।


ক্রনিক শরীরের ব্যথার কারণগুলো হল:

  • ফিব্রোমিয়ালগীয়া - শরীরে একাধিক জায়গায় ব্যথা যেগুলো স্পর্শ করলে নমনীয় হয়
  • মনোবিদ্যাগত কারণ - চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্নতা
  • পুষ্টির অভাব - ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি১২, আয়রন
  • ক্রনিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রোম - স্ট্রেস বা অতিরিক্ত শারীরিক কাজ না থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন অবিরত এবং নিরন্তর ক্লান্তির অনুভূতি
  • অটোইমিউন রোগ - রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, লুপাস
  • ক্রনিক সংক্রমণ - টিউবারকুলোসিস, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি


শরীরের ব্যথা কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
কখনো কখনো, অল্প শরীরের ব্যথার রোগ নির্ণয় করা কঠিন হয়; তবুও, একটি পর্যাপ্ত চিকিৎসার ইতিহাসের সাথে ক্লিনিকাল পরীক্ষা শরীরে ব্যথার কারণ নির্ণয় করতে সাহায্য করে। চিকিৎসার ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি শরীরের ব্যথাটির কারণ জানতে কিছু রক্ত পরীক্ষা করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাগুলি হল:

  • সম্পূর্ণ রক্ত গণনা (complete blood count) - অ্যানিমিয়া নির্ধারণ করতে সাহায্য করে
  • এরিথ্রোসাইট সেডিমেনটেশন রেট (ইএসআর) এবং সি-রিএক্টিভ প্রোটিন (সিআরপি) - শরীরের উপস্থিত প্রদাহ নির্মূল করতে সাহায্য করে।
  • আলকালাইন ফসফাটেজের সাথে এ্যাসপার্টেট ট্রান্সামিনেস - পেশী ভাঙনের ঘটনা নিশ্চিত করে।
  • রহিউমাটোয়েড আর্থ্রাইটিস (আরএ) ফ্যাক্টর - রহিউমাটোয়েড আর্থ্রাইটিসের নির্ণয় নিশ্চিত করার জন্য করা হয়।
  • অ্যান্টি নিউক্লিয়ার অ্যান্টিবডি - শরীরে ব্যথার যেকোন অটো-ইমিউন কারণ দূর করতে করা হয়।
  • ভিটামিন বি১২ এবং ডি৩ লেভেলস - ভিটামিন বি১২ এবং ডি৩ এর পুষ্টির অভাবকে দূর করতে করা হয়।

এমনকি এই পরীক্ষার পরেও, যদি কারণটি জানা না যায়, তবে মানসিক বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সাথে একটি সেশন, চাপ, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার মত অন্তর্নিহিত মানসিক কারণগুলি নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে।

একবার কারণ জানা গেলে, তার উপর নির্ভর করে, চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয় করা হয়। কিছু রোগীর শুধুমাত্র লক্ষণগুলির চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে, কারোর কাউন্সিলিং সেশনের পাশাপাশি কেবল প্লাসিবোর প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত নির্দিষ্ট ওষুধগুলো হল:

  • এনালজেসিকস - প্যারাসিটামল বা নন-স্টেরয়েডাল এন্টি-ইনফ্ল্যামাটরি ড্রাগস (ডিক্লোফেন্যাকের মতো) ব্যথা উপশম করার জন্য নেওয়া যেতে পারে।
  • মাসল রিলাক্সান্টস - শারীরিক ব্যথা টানটান পেশীর কারণে হতে পারে; পেশীর রিলাক্সেন্টস নিলে তা শরীরকে ব্যথা মুক্ত করতে সাহায্য করতে পারে।
  • ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস - শরীরের ব্যথা যদি পুষ্টিকর ঘাটতির কারণে হয় তবে ভিটামিন বি১২ (বা এমনকি বি কমপ্লেক্স), ভিটামিন ডি (ক্যালসিয়াম সহ) গ্রহণ, দ্রুত ব্যথা উপশম করতে পারে।
  • এঞ্জায়লাইটিক্স বা অ্যান্টি-ডিপ্রেশনস - এইগুলি দোকানে গেলেই পাওয়ার মতো ওষুধ নয়, এবং এগুলো পেতে হলে সাধারণত একজন মনোবৈজ্ঞানিকের প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন হয়, তবে অন্তর্নিহিত কারণটি যদি মানসিক উৎস হয় তবে এই ওষুধগুলি সাহায্য করতে পারে।
  • নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, যখন শরীরের ব্যথা পেশীর টানটান হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়; তখন ফিজিওথেরাপি, আকুপাংচার, ম্যাসেজ, বা অন্যান্য বিকল্প থেরাপি উপসর্গগুলি থেকে ভাল পরিত্রান দিতে পারে।


ঘরোয়া উপায়ে শরীর ব্যাথা দূর করার কিছু উপায়:
১. কোল্ড থেরাপি করুন:

শরীরের ব্যথার অংশে বরফ লাগালে- ব্যথা কমানোর জন্য বরফ সেই অঞ্চলের স্নায়ু আবেগকে ধীর করে দেয়। যার ফলে ব্যথা কমতে থাকে। বাতের ব্যথা রোগীদের ক্ষেত্রেও জয়েন্টগুলির ব্যথার অংশে বরফ লাগালে ব্যথা কমে যাবে।

এটা কিভাবে করতে হবে:
ক .একটি ছোট তোয়ালে তিন বা চারটি বরফ এর টুকরো গুলিকে মুড়িয়ে ব্যথার জায়গায় লাগিয়ে রাখতে পারেন।

খ.জেল আইস প্যাকস, পেইন রিলিফ কোল্ড স্প্রে ব্যথার স্থানে ব্যবহার করতে পারেন। যার ফলে ফোলা ও ব্যথা হ্রাস পাবে।

আপনি দিনে দুই বা তিনবার এই প্রতিকারটি করতে পারেন।

২. সরিষার তেল দিয়ে ম্যাসাজ করুন:
গরম সরিষার তেল দিয়ে আপনার শরীরে মালিশ করলে ব্যথা উপশম হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে সরিষার তেলে অ্যালিল আইসোথিয়োকানেট নামে একটি রাসায়নিক যৌগ থাকায় এটি দেহের ব্যাথা হ্রাস করে।

এটা কিভাবে করতে হবে: মাইক্রোওয়েভে বা একটি প্যানে এক কাপ সরিষার তেল গরম করুন। তেল খুব বেশি গরম হতে দেবেন না। মাঝারি গরম তেল দিয়ে পুরো শরীরটি ম্যাসাজ করুন এবং গোছল করার আগে কমপক্ষে ১০ মিনিটের জন্য এটি শরীরে রেখে দিন। আপনি এই প্রতিকারটি সপ্তাহে একবার বা দুবার করতে পারেন।

৩. আদা চা পান করুন:
বিজ্ঞানীরা আদায় আইবুপ্রোফেন (একটি রাসায়নিক যৌগ) থাকায় তারা এটিকে শক্তিশালী ব্যথানাশক এর সাথে তুলনা করেছেন। আদা শরীরের ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে।

এটি কিভাবে ব্যবহার করতে: একটি প্যানে পানিতে ২ টুকরো আদা মিশ্রিত করে ৫ থেকে ১০ মিনিট ফোটান। পরে নামিয়ে আবার আদাকে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে দিন এবং তারপরে সারা দিন আস্তে আস্তে পানি পান করুন। আদা খাওয়ার আরেকটি উপায় হল আপনার নিয়মিত চায়ে এক চা চামচ আদা যোগ করা। আপনি এই প্রতিকারটি দিনে একবার ব্যবহার করতে পারেন।

৪. দেহের ব্যথার জন্য হলুদ:
হলুদে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ব্যথানাশক ওষুধের বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দেহের ব্যথা উপশম করতে সহায়তা করে। হলুদ শরীরের সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও উন্নত করে।

কিভাবে ব্যবহার করে: এক গ্লাস উষ্ণ দুধে এক চামচ হলুদ ও মধু যোগ করে খেতে হবে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে এই দুধ পান করুন। আপনি প্রতিদিন একবারে এই প্রতিকারটি ব্যবহার করতে পারেন।

৫. দারুচিনি:
দারুচিনি কেবল খাবারের স্বাদই বৃদ্ধি করে না, শরীরের ব্যাথা নিরাময়েও সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে দারুচিনিতে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যানালজেসিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা ব্যাথানাশক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

কিভাবে ব্যবহার করে: এটি তৈরির জন্য আপনি তিন বা চারটি দারুচিনি পিষে নিতে পাউডার তৈরি করতে পারেন। তারপরে আধা চা চামচ দারচিনি গুঁড়ো, এক গ্লাস গরম দুধের সাথে, এক চামচ মধু মিশিয়ে খান। আপনি প্রতিদিন একবার এই দুধ পান করতে পারেন।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে