মস্তিষ্কে আঘাত কি?
প্রতি বছর বাংলাদেশে কতজন মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, এর কোনো সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই। মাথায় আঘাত বা হেড ইনজুরির প্রধান কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। এ ছাড়া গাছ বা দালান থেকে পড়ে যাওয়া, মারামারিতে, খেলাধুলার সময়, শক্ত স্থানে বা বাথরুমে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে মানুষ মাথায় আঘাত পেয়ে থাকেন।

মাথায় আঘাত লাগার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মস্তিষ্কে আঘাত। মস্তিষ্কে আঘাত বলতে বোঝায় মস্তিষ্কের কোষগুলির কোনও রকম ক্ষতি হওয়া আর তার থেকে কোষগুলির মৃত্যু অথবা ধ্বংস হওয়া। এটা বাইরের আঘাত অথবা ভিতরের বিষয়গুলির কারণে ঘটতে পারে। যেহেতু মস্তিষ্ক হল সমস্ত শরীরের ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, তাই মস্তিষ্কে যেকোন রকম আঘাত শরীরের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। মস্তিষ্কের আঘাতগুলি হালকা, মাঝারি অথবা তীব্র হতে পারে, এবং প্রায়ই মারাত্মক হতে পারে।

মস্তিষ্কে আঘাতের প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
মস্তিষ্কের যে অংশে আঘাত লেগেছে, মস্তিষ্কে আঘাতের লক্ষণগুলি এবং উপসর্গগুলি তার ওপর নির্ভর করে। এই উপসর্গগুলিকে বিস্তৃতভাবে শ্রেণিবিভক্ত করা যেতে পারে - জ্ঞানীয়, আচরণগত, ইন্দ্রিয়লব্ধ এবং শারীরিক।

জ্ঞানীয় উপসর্গগুলির মধ্যে যা অন্তর্ভুক্ত:

  • বুঝতে অসুবিধা
  • ভাবনা এবং চিন্তাধারা প্রকাশে অসুবিধা
  • মনোযোগের অভাব
  • সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভাব
  • স্মৃতির হ্রাস।


আচরণগত উপসর্গগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হল:

  • বিরক্তি
  • উত্তেজিত এবং আগ্রাসী মনোভাব
  • চাপ কম সহ্য করতে পারা
  • আলস্য
  • মানসিক চাঞ্চল্য।


ইন্দ্রিয়লব্ধ উপসর্গগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হল:

  • দৃষ্টি, শ্রবণ অথবা স্পর্শের পরিবর্তিত অনুভূতি
  • চিনতে না পারা
  • স্বাদ এবং গন্ধের পরিবর্তন
  • ভারসাম্যের অসুবিধা
  • ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা হ্রাস।


শারীরিক উপসর্গগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হল:

  • তীব্র এবং একনাগাড়ে মাথাব্যথা
  • অবসাদ
  • পক্ষাঘাত
  • কম্পন (কাঁপা) এবং খিঁচুনি
  • আলোকাতঙ্ক (আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা)
  • কথাবার্তায় অস্পষ্টতা
  • চেতনা হারানো
  • ঘুমের অসুবিধা।


মস্তিষ্কে আঘাতের প্রধান কারণ কি?
মাথায় অক্সিজেনের সরাবরাহ বন্ধের কারণে প্রধানত মস্তিষ্কে আঘাত ঘটে, যার ফলাফল হল ব্রেন হাইপোক্সিয়া। কারণগুলি বাহিরের এবং ভিতরের আঘাত হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ।

বাহিরের আঘাতের কারণগুলি (আঘাতমূলক) অন্তর্ভুক্ত করা হল:

  • উচু স্থান থেকে পতন
  • সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আঘাত
  • ক্রীড়াঘটিত আঘাত
  • মাথায় আঘাত।


ভিতরের আঘাতের কারণগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হল:

  • স্ট্রোক
  • টিউমার
  • অ্যানিউরিজম (মাথার মধ্যে একটি রক্তবাহিকার বিকৃতি)
  • সংক্রমণ
  • বিষ প্রয়োগ
  • ওষুধের অপব্যবহার
  • স্নায়ুর অসুস্থতা।


কিভাবে এটা নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
একটি বিশদ রোগ সম্বন্ধীয় ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষা মস্তিষ্কে আঘাতের রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। কিন্তু, আঘাতের ব্যাপ্তি, প্রবলতা এবং আরোগ্য সম্ভাবনা জানতে সুনিশ্চিত অনুসন্ধান দরকার। যে সকল পরীক্ষাগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়:

  • কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যান: এটি হল প্রথম রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা যা মাথার খুলিতে চিড়, রক্তপাত, হেমাটোমা এবং কলায় ফোলাভাব অনুসন্ধান করায় সাহায্য করে।
  • ম্যাগনেটিক রিজোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) স্ক্যান: এটি হল সিটি স্ক্যানের তুলনায় অধিক যথাযথ এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ। এটি মাথা এবং তার বিভিন্ন অংশের একটি বিশদ দর্শন দেয়।
  • চিকিৎসকদের দ্বারা মস্তিষ্কে সংক্রমণের তীব্রতা মূল্যায়নের জন্য গ্লাসগো কোমা স্কেলটি ব্যবহার হয়। সর্বোচ্চ স্কোরগুলি নির্দেশ করে কম তীব্র আঘাতের, আর নিম্ন (কম) স্কোরগুলি নির্দেশ করে তীব্র আঘাতের।


মস্তিষ্কে আঘাতের চিকিৎসা প্রাথমিক ভাবে নির্ভর করে এটার প্রখরতার ওপর। সাধারণত একটি হালকা আঘাতে কেবলমাত্র উপসর্গগুলির পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন এবং কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে, মাঝারি এবং তীব্র আঘাতের ক্ষেত্রে ভালভাবে চিকিৎসা করার প্রয়োজন। সাধারণ ওষুধ প্রয়োগ থেকে শুরু করে অনেকক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হতে পারে।

মস্তিষ্কে আঘাতের ক্ষেত্রে ওষুধজনিত চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত:

  • অ্যান্টি-সিজার ড্রাগস - মস্তিষ্ক আঘাতের একটি সাধারণ উপসর্গ হল খিঁচুনি ধরা এবং তার থেকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মস্তিষ্ক। এক্ষেত্রে, অ্যান্টি-সিজার ওষুধগুলি চিকিৎসায় দারুন সাহায্য করে।
  • ডায়ইউরেটিক্স - কিছু ধরণের মস্তিষ্কের সংক্রমণের ফলাফলে মস্তিষ্কের চারিদিকে ফুলে ওঠে। ডায়উউরেটিক্সের ব্যবহার এই ফোলা কমাতে পারে এবং চাপজনিত উপসর্গগুলি প্রশমনে সাহায্য করে।
  • কোমা ইনডিউসিং ড্রাগস- যখন মাথা নিজেকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে, এটি বাড়তি অক্সিজেন ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু, যদি রক্ত ধমনীগুলো সঙ্কুচিত অথবা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এটি যথেষ্ট অক্সিজেন পায় না, এবং এটি পুনরায় মাথার কোষগুলির আঘাত এবং মৃত্যুর কারণ হয়। এটিকে পরিহার করতে, অক্সিজেনের প্রয়োজন কমাতে এবং মাথার কোষগুলোকে কার্যকরী করতে কোমা ইনডিউসিং ড্রাগস ব্যবহার করা হয়।


মস্তিষ্কে আঘাতের জন্য সার্জারির ভূমিকায় অনেক পদ্ধতি রয়েছে, সাধারণত যেগুলি অন্তর্ভুক্ত:

  • খুলির চিড় মেরামত করা
  • মাথা থেকে রক্তের ডেলা সরানো
  • রক্তপাতপূর্ণ ধমনীর সেলাই
  • মস্তিষ্কে চাপ দূর করতে একটি ফাঁক তৈরি
  • সার্জারি এবং ওষুধের একপাশে, মাথার ক্ষতির দ্বারা আক্রান্ত অঙ্গগুলি এবং মাথার কার্যকারীতা ভাল করতে পুনর্বাসন প্রয়োজনীয়। ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, কাউন্সেলিং এবং রিক্রিয়েশন থেরাপি পুনর্বাসনের অন্তর্ভুক্ত।


শেষকথা
মাথায় চোট লাগা হল সবসময়ই আপৎকালীন অবস্থা। এই অবস্থায় সবসময় দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তিনিই আপনাকে এই সমস্যা থেকে বাঁচাতে পারেন। মস্তিষ্কের আঘাতজনিত জখম বিশ্বজুড়েই মানুষের মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের একটি অন্যতম কারণ। বিশেষ করে শিশু ও অল্পবয়স্করা এর স্বীকার বেশি হয়। নারীদের তুলনায় পুরুষের এ ধরনের জখমের পর টিকে থাকার হার বেশি। বিংশ শতকে হওয়া জ্ঞান ও প্রযুক্তিমূলক উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে এ ধরনের জটিলতার রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় অনেক বেশি উন্নতি হয়ে যার ফলে চিকিৎসালব্ধ ফলাফলের উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে মৃত্যুর হারও কমে এসেছে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে