ছানি বা ক্যাটারাক্ট কি?
আমাদের চোখটি একটি বলের মতো, গোল। এই বলের ভেতরে অনেক আবরণ আছে। এর সামনে রয়েছে কর্নিয়া এবং লেন্স। এই দুটো কর্নিয়া এবং লেন্স মিলে বাইরের যা আলোক রশ্মি রয়েছে যেগুলো আমাদের চোখে প্রতিফলিত করে, সেটাতে যে একটা প্রতিবিম্ব পড়ে চোখের ভেতরে, চোখের পেছনের রেটিনাতে, ওই প্রতিবিম্বটা চোখের পেছনের রেটিনা থেকে মস্তিস্কে চলে যায়, তখন আমরা দেখতে পাই। দেখার সম্পূর্ণ পদ্ধতিটি একটি ক্যামেরার মতো কাজ করে। বাইরে থেকে আলো চোখের ভেতরে পড়ে, এরপর আস্তে আস্তে করে একটি প্রতিবিম্ব তৈরি হয় রেটিনাতে, সেটা মস্তিস্কে চলে যায়। ফলে আমরা দেখতে পাই। তবে এই কর্নিয়া এবং লেন্স যে রয়েছে এ দুটো স্বচ্ছ হতে হবে এবং মাধ্যমটা পুরোটা স্বচ্ছ হতে হবে। যদি কোথাও কোনো অস্বচ্ছতা থাকে, তাহলে আর প্রতিবিম্বটা পড়বে না। আমাদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বা অন্য যেকোনো কারণে যদি চোখের লেন্স অস্বচ্ছ হয়ে যায়, সেখানে অন্য কোনো আবরণ পড়ে যায়, লেন্সটাই অস্বচ্ছ হয়ে যায়, এই লেন্স অস্বচ্ছ হয়ে গেলে আমরা তাকে বলি ছানি। এটি সাধারণত ঘোলাটে ও সাদা রঙের হয়।

ছানির প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
প্রাথমিক অবস্থায় ছানি হয়েছে কিনা তা বুঝে ওঠা খুব কঠিন। ছানি পড়া অসুখটি যতদিন যায় বাড়ে কিন্তু এত ধীর গতিতে হয় যে দৃষ্টি শক্তিতে পরিবর্তন এলে তা আমরা বুঝতে পারি না। অনেক ক্ষেত্রেই ছানি পড়া ব্যপারটি বার্ধক্যের লক্ষণ। এই অসুখের লক্ষণগুলি যখন ফুটে ওঠে, তখনই একে ছানি পড়া বা ক্যাটারাক্ট বলে। চোখে ছানি পড়ার উপসর্গ গুলি হল:

  • লেন্সের রং ঘোলা হয়ে যাওয়া
  • আবছা এবং ঘোলাটে দৃষ্টি
  • রাতে দেখতে অসুবিধা হওয়া
  • পরিষ্কারভাবে পড়া ও দেখার জন্য বড়ো হরফের লেখা ও বেশি মাত্রার আলোর প্রয়োজন
  • রঙিন জিনিসে উজ্জ্বলতা প্রত্যক্ষ না করতে পারা
  • সূর্যের আলো ও তার তীব্রতায় অসুবিধা হওয়া
  • একই জিনিস একসঙ্গে দুটি দেখা বা ডবল ভিশন
  • উজ্জ্বল বস্তুর চারপাশে চক্র বা বর্ণবলয় দেখা
  • প্রেসক্রিপশন ও চশমার নম্বর ঘন ঘন বদলানো।


কাদের ছানি বেশি হয়?
চোখের ছানি সাধারণত বয়স্কদের বেশি হয়। ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়স্কদের জন্য এটা খুবই সাধারণ একটি অসুখ। তবে সব সময় বয়স্কদেরই হবে এমনটা ভাবা ভুল। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের অপেক্ষাকৃত কম বয়সে ছানি হতে দেখা যায়। এমনকি ছানি হতে পারে ছোটদেরও। গর্ভবতী মায়ের কিছু জীবাণু সংক্রমণ হলে সন্তানের চোখে ছানি থাকতে পারে জন্ম থেকেই। গর্ভবতী মায়ের গর্ভধারণের তিন মাসের মধ্যে এক্স-রের মতো কোনো বিকিরণ রশ্মির সংস্পর্শে এলেও গর্ভের সন্তানের জন্মগত ছানির ঝুঁকি থাকে। ছোটদের বা বড়দের চোখে মারাত্মক আঘাত থেকে ছানি হতে পারে। ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন কিংবা বিকিরণ এলাকায় কাজ করেন, এমন ব্যক্তির ছানি হওয়ার ঝুঁকি থাকে যেকোনো বয়সে।

কম বয়সে ছানি পড়ার কারণ কী?
ডায়বিটিস থাকলে কম বয়সে ছানি পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। আবার সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে চোখের লেন্স ঝাপসা হয়ে যেতে পারে, আবার বংশগত কারণেও অল্প বয়সে ছানি পড়ার সম্ভাবনা থাকে। অল্প বয়সে ছানি পড়ার আর একটা বড় কারণ অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস অর্থাৎ অ্যালার্জি। আবার মায়োটনিক ডিস্ট্রফি নামে পেশির কর্ম ক্ষমতা কমে যাওয়ার অসুখ থাকলেও বৃদ্ধ হবার আগেই ছানি পড়ে দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। যাঁদের হাই মাইনাস পাওয়ার অর্থাৎ হাই মাইওপিয়া, চোখের ক্রনিক সংক্রমণ, রাতকানা রোগ থাকলেও কম বয়সে ছানি পড়ার ঝুঁকি বেশি।

ছানি পড়ার প্রধান কারণ কি কি?
ক্যাটারাক্ট বা চোখে ছানি পড়ার জন্য যে কারণগুলি দায়ী:

  • বয়স বাড়া
  • চোখের লেন্স যে টিস্যু বা কলাগুলির দ্বারা তৈরি হয় তাতে পরিবর্তন আসা
  • জিনগত অসুখ
  • ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগের মতো অন্যান্য অসুখ
  • আগে যদি চোখে অস্ত্রোপচার, সংক্রমণ ইত্যাদি কোনও সমস্যা হয়ে থাকে
  • দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন
  • ধূমপান ও অ্যালকোহলে আসক্তি
  • সূর্যের অতিরিক্ত তাপ কিংবা অতিবেগুনি রশ্মিতে কাজ করা
  • চোখে আঘাত পাওয়া
  • ভিটামিনের ঘাটতি।


ক্যাটারাক্ট বা চোখে ছানি কিভাবে নির্ণয় করা হয় এবং এর চিকিৎসা কি?
চক্ষু পরীক্ষা, রোগীর পূর্বেকার ডাক্তারি ইতিহাসের মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে এই অসুখের ব্যাপারে ডাক্তার নিশ্চয়তায় আসেন ও তারপর যে পরীক্ষাগুলি করেন:

  • কোনও পাঠ্যবস্তু ঠিক মতো পড়তে পারছে কিনা তা দেখার জন্য ভিশন টেস্ট বা দৃষ্টি পরীক্ষা
  • চোখের লেন্স, কর্নিয়া বা চোখের তারার আবরণ, আইরিশ এবং তাদের মধ্যে সঠিক দূরত্ব রয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য স্লিট ল্যাম্প পরীক্ষার সাহায্য নেওয়া হয়
  • ছানি হয়েছে কিনা জানার জন্য রেটিনা বা অক্ষিপটের পরীক্ষা


চিকিৎসা:

চোখের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চশমার ব্যবহার করেও যদি সুরাহা না হয়, তাহলে ছানি থেকে মুক্তি পাওয়া ও দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর জন্য অস্ত্রোপচার করানো প্রয়োজন। চোখে ছানি হলে তার একমাত্র চিকিৎসা হলো অপারেশন করে চোখের ছানি অপসারণ করা। অনেকেই মনে করেন ছানি বেশি বড় হলে তবে অপারেশন করা উচিত। এটা খুবই ভয়াবহ একটি ভুল ধারণা। কখন অস্ত্রোপচার করা নিরাপদ, সেটি চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছানির অবস্থা দেখে বলে দেবেন। বেশি দেরি হয়ে গেলে ছানিজনিত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন : গ্লুকোমা ও লেন্স ডিজলোকেশন বা চোখের লেন্স নির্দিষ্ট স্থান থেকে সরে যাওয়া, দৃষ্টি হারানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আজকাল অতি উন্নতমানের চোখের ছানির অপারেশন যেমন ফ্যাকো, SICS, ECCE ইত্যাদি হয়ে থাকে। অনেক সময় অপারেশনের পরে চশমা পরার প্রয়োজন হতে পারে।

চোখের ছানি প্রতিরোধের উপায়:

চোখের ছানি এড়ানোর জন্য নিয়মিত চোখের যত্ন নেওয়া, দীর্ঘমেয়াদি অসুখ হলে তার চিকিৎসা করা, চোখের ডাক্তারের কাছ থেকে নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করার মতো নিয়মসমূহ মেনে চলা জরুরি। এছাড়া যেসব খাবারের উপাদান সমূহ চোখের জন্য উপকারী সেসব খাবার খাওয়ার দ্বারা ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। যেমন-রসুন (অ্যালিসিনন), বাদাম (ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড), পালংশাক (ফাইটো নিউট্রেয়ান্ট), গাজর (ভিটা ক্যারোটিন) পেঁপে (প্যাপিন), মধু, অশ্বগন্ধা, গ্রিন টি ইত্যাদি। চোখের ছানি হলে অন্ধ হয়ে যেতে হবে এমন ভয় না পেয়ে যত দ্রুত সম্ভব চক্ষুবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। তাতে রোগমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে