হেঁচকি কি?
হেঁচকি (ইংরেজি: hiccup/hiccough) হলো মধ্যচ্ছদা বা ডায়াফ্রামের অনৈচ্ছিক সংকোচনের ফলে সৃষ্ট ঝাঁকুনি যা প্রতি মিনিটে কয়েকবার হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে এটি সিনক্রোনাস ডায়াফ্রাগমাটিক ফ্লাটার (SDF), বা সিংগুল্টাস (singultus) নামে পরিচিত। হেঁচকি একটি অনৈচ্ছিক ক্রিয়া যা একটি রিফ্লেক্স আর্কের সাথে সম্পর্কিত। একবার উদ্দীপনা সৃষ্টি হলে রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্তী ক্রিয়ার মাধ্যমে খুব জোরের সাথে ডায়াফ্রামের সংকোচন ঘটে, এর প্রায় ০ দশমিক ২৫ সেকেন্ড পরে ভোকাল কর্ড বন্ধ হয়। এর ফলেই হিক শব্দের উৎপত্তি হয়। বাংলায় হেঁচকি শব্দটি হিক্কা নামেও পরিচিত। হেঁচকির ছন্দ বা দুই হেঁচকির মধ্যবর্তী সময় ব্যবধান প্রায় ধ্রুব বা স্থির থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো চিকিৎসা ছাড়াই হেঁচকি এমনি ভালো হয়ে যায়। অনেকে ঘরোয়া অনেক পদ্ধতি ব্যবহার করে হেঁচকি থামানোর চেষ্টা করেন। দীর্ঘস্থায়ী হেঁচকি উপশমে ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে। যে হেঁচকি সর্বশেষ ৪৮ ঘণ্টার ওপর একটুকুও না কমে থাকে তাকে দীর্ঘস্থায়ী হেঁচকি বলে।

হেঁচকির সাথে জড়িত প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো কি কি?
এই অবস্থার প্রধান লক্ষণটি হল তাদের আপনা-আপনি হেঁচকি ওঠা। কিন্তু, দীর্ঘক্ষণ ধরে হেঁচকি উঠতে থাকলে, অন্য আরও লক্ষণও দেখা দিতে পারে, যা হল:

  • ঘুমের অভাব
  • কিছু খেতে বা পান না করতে পারা
  • ক্লান্তি
  • ওজন কমে যাওয়া
  • ডিহাইড্রেশন
  • বমির ভাব অথবা বমি।


হেঁচকির প্রধান কারণগুলো কি কি?
বিভিন্ন কারণে হেঁচকি হতে পারে। যেমন:

  • কাশি
  • এরোফেজিয়া (aerophagia) বা প্রচুর বায়ু ভক্ষণ।
  • গ্যাস্ট্রোইসোফ্যাজিয়াল রিফ্লাক্স বা পাকস্থলীয় খাদ্য উপাদান বা রস খাদ্যনালীতে উঠে আসা।
  • হাইয়াটাস হার্নিয়া।
  • খুব দ্রুততার সাথে ভক্ষণ।
  • প্রচণ্ড আবেগধর্মী ব্যাপার যেমন ভয়, উদ্বেগ, উত্তেজনা, আনন্দ, ইউফোরিয়া বা ভালোলাগার অনুভূতি।
  • কোমল পানীয়, অ্যালকোহল, শুকনা রুটি,কিছু মশলাযুক্ত খাবার।
  • অপিয়েট ড্রাগের ব্যবহার।
  • হাসি।


বিরল ক্ষেত্রে অসুখের লক্ষণ হিসেবেও হেঁচকি হতে পারে, যেমন:

  • কিডনি ফেইলিউর
  • স্ট্রোক
  • মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস
  • মেনিনজাইটিস
  • শল্যচিকিৎসার ফলে ভ্যাগাস স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।


কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
যদি আপনার হেঁচকি ৩ ঘণ্টার বেশি হয় অথবা হেঁচকির কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, খাবার খেতে সমস্যা হয়, বমির ভাব অথবা বমি হয় তাহলে দেরী না করে ডাক্তার দেখানো উচিত।

হেঁচকির চিকিৎসাঃ
রোগীর অবস্থার ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে। হেঁচকি সাধারণত এমনিতেই ভালো হয়ে যায় তবে অনেকেই কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যবহার করে হেঁচকি থামানোর চেষ্টা করেন। চমকিয়ে দেয়া বা ভয় দেখানো, ব্যাগের মধ্যে নিঃশ্বাস ছাড়া ও নেয়া, জিহ্বার উপরে বা নিচে চিনি রাখা, বড়ো চামচের এক চামচ চীনাবাদামের মাখন খাওয়া, পুরা একগ্লাস পানি এক নিঃশ্বাসে পান করে কয়েকবার বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস টানা ইত্যাদি।

সহজ তত্ত্ব হলো কার্বনডাইঅক্সাইড CO2 এর আংশিক চাপ বৃদ্ধি করা ও নিঃশ্বাস বন্ধ রাখার মাধ্যমে ডায়াফ্রামের ক্রিয়াকে নিবৃত করার চেষ্টা করা। দীর্ঘস্থায়ী হেঁচকির ক্ষেত্রে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর যেমন ওমিপ্রাজল, মেটোক্লপ্রামাইড, ক্লোরপ্রোমাজিন, ব্যাকলোফেন, হ্যালোপেরিডল, গাবাপেন্টিন ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহারে উপকারিতা পাওয়া যায়।

হেঁচকি হলে আপনি কি করবেন?
আপনি নিশ্চয়ই হেঁচকি হলে কি করতে হবে, এই ব্যাপারে অনেক ধরনের করনীয় শুনেছেন। হয়তো নিজের বা কাছের মানুষের ক্ষেত্রে সেগুলো প্রয়োগও করেছেন। সে রকম কিছু কার্যকরী করনীয় হচ্ছেঃ

  • হেঁচকি হলে শ্বাস কিছুক্ষণ ধরে রাখুন এবং আস্তে আস্তে শ্বাস ছেড়ে দিন। এভাবে প্রতি ২০ মিনিটে ৩-৪ বার করুন অথবা কাগজের ব্যাগের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিন, তবে সেটা যেন একবারে ১ মিনিট এর বেশি না হয়। (এই দুই পদ্ধতির মাধ্যমে আপনার রক্তে কার্বন-দাই-অক্সাইড এর পরিমাণ বেড়ে যাবে, যেটা diaphragm এর হঠাৎ হওয়া সংকোচন রোধ করবে)
  • হেঁচকির সময় কেউ যদি আপনাকে ভয় পাইয়ে দেয় অথবা চমকে দেয়, তাহলে হেঁচকি বন্ধ হয়ে যাবে। (এক্ষেত্রে অনেক মজার ব্যাপার ঘটে, যখন আপনাকে কেউ ভয় পাইয়ে দেয় তখন আপনার শরীর এটার বিপরীতে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য তৈরি হয়ে যায়, এর ফলে আপনার শরীর হেঁচকির কথা বেমালুম ভুলে যায়! মূলত,এই সময়ে আপনার vegus nerve আপনার শরীরকে “Fight-or-fight response” mood-এ দিয়ে আপনাকে হেঁচকি থেকে বাঁচিয়ে দেয়। **Fight-or-fight response হচ্ছে এমন এক ধরনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া যেটা আপনার উপর যখন কোন ধরনের হামলা হয় তখন কাজ করে। যেমনঃ কেউ আপনাকে মারতে এলে আপনি নিজের অজান্তেই আটকানোর চেষ্টা করবেন )
  • হেঁচকি হলে সাথে সাথে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাবেন ( ঠাণ্ডা পানি diaphragm এর irritation বন্ধ করে এবং সংকোচন প্রসারণ আবার স্বাভাবিক করে)
  • গ্লাস এর বিপরীত পাশ থেকে পানি খেতে হবে( একটু ভেঙ্গে বলছি, প্রথমে আপনার হাতে থাকা গ্লাস টি পানি দ্বারা পূর্ণ করবেন এবং গ্লাসটি স্বাভাবিক ভাবে ধরে রাখুন। খেয়াল করলে দেখবেন, আপনার বুড়ো আঙ্গুল আপনার দিকে এবং বাকি চারটি আঙ্গুল আপনার বিপরীত দিকে আছে। আমরা সাধারণত যেদিকে বুড়ো আঙ্গুল আছে সেদিকে মুখ দিয়ে পানি পান করি, কিন্তু এক্ষেত্রে যেদিকে অন্য চারটি আঙ্গুল আছে সেদিকে মুখ দিয়ে পানি পান করবেন অর্থাৎ স্বাভাবিক এর তুলনায় বিপরীত পাশ দিয়ে পানি পান করবেন। এভাবে পানি পান করার সময় আপনাকে মাথা এবং পিঠ ঝুকাতে হয়, এভাবে খাওয়ার জন্য আপনার পেটের পেশিতে চাপ পড়ে বা সংকুচিত হয়। যা হেঁচকি দূর করতে সাহায্য করে)


এই কয়েকটি সহজ উপায় আপনার হেঁচকিকে বাই-বাই জানাতে সাহায্য করবে!


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে