কুশিং সিনড্রোম কি?
কুশিং সিনড্রোম (ইংরেজি:Cushing Syndrome) হল একটি হরমোন ঘটিত রোগ, যা শরীরে কর্টিসল হরমোনের অনিয়মিত ক্ষরণের জন্যে (স্বাভাবিক কর্টিসল স্তরের চেয়ে বেশী) হয়। কর্টিসলকে “স্ট্রেস হরমোন” বলা হয় কারণ অধিক মানসিক চাপের সময় এই হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এর কারণ অভ্যন্তরীণ (শরীরের ভেতরের কোনো সমস্যার কারণে) বা বাহ্যিক (পারিপার্শ্বিক থেকে উদ্ভূত কোনো কারণ) হতে পারে। উচ্চমাত্রায় গ্লুকোকর্টিকয়েড ড্রাগ গ্রহণ কিংবা অতিরিক্ত কর্টিসল, অ্যাড্রেনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন (ACTH) এর কারণেও হতে পারে। পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার হলে অতিরিক্ত ACTH ক্ষরণ হয় যা অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে কর্টিসল তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। গ্লুকোকর্টিকয়েড জনিত কারণ ছাড়া এই কারণই ৭০ ভাগ দায়ী। কুশিং রোগ থেকে কুশিং সিনড্রোম পৃথককরণের সহজ উপায় হল কুশিং সিনড্রোমে ACTH এর মাত্রা কম থাকে। এর কারণ কর্টিসল নেগেটিভ ফিডব্যাক মেকানিজম এর মাধ্যমে হাইপোথ্যালামাস এবং সম্মুখ পিটুইটারিকে নিবারণ করে থাকে।

কুশিং সিনড্রোমের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
চিকিৎসাগত বৈশিষ্ট্যগুলি বিভিন্ন হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী উপসর্গগুলি হল:

  • স্থূলতা, সাধারণত শরীরে ওপর দিকে দেখা যায়
  • মুন ফেস বা চাঁদের মতো গোল পেশীবহুল মুখ
  • কাধ এবং ঘাড়ে ষাঁড়ের মতো কুঁজ হওয়া, যাকে বাফেলো হাম্পও বলা হয়।
  • অনিয়মিত মাসিক
  • যৌন সঙ্গমের ইচ্ছা কমে যাওয়া
  • সাইকোসিস (একটি মারাত্মক মানসিক অসুখ)
  • সর্বাঙ্গীন জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি সম্বন্ধনীয় অসুস্থতা
  • হাড়ে চির ধরা
  • শিশুদের অনিয়মিত বৃদ্ধি।
  • ঘন ঘন মন-মেজাজের পরিবর্তন হওয়া।
  • মেদ বেড়ে যাওয়া।
  • ঘা শুকাতে সময় নেয়া।
  • সহজেই ত্বক ছিলে যাওয়া।
  • ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া।
  • মাথাব্যথা।
  • বিষণ্নতা ও উদ্বেগ।
  • স্মৃতিভ্রম।
  • অস্থিক্ষয়।
  • পেশিতে দুর্বলতা।
  • উচ্চ রক্তচাপ।
  • ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া ও মূত্রত্যাগের ইচ্ছা জাগা।


প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে এই রোগ দেখা যায় কিন্তু শিশুদেরও এই রোগ হতে পারে। পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে এই রোগের আধিক্য অনেক বেশি (মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে অনুপাত ৩:১)। কিছু বিরল লক্ষণ হল:

  • সংক্রমণ
  • অনিদ্রা
  • ত্বক মোটা হয়ে যাওয়া এবং স্ট্রেচ মার্ক বা প্রসারিত চিহ্নের আবির্ভাব
  • মহিলাদের টাক পড়া।


অন্য যে রোগে একই উপসর্গগুলি দেখা যায় (অন্যান্য রোগ):

  • পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওডি)।
  • বিপাকক্রিয়াজনিত উপসর্গ (অনেকগুলি শারীরিক অসুবিধার সমন্বয় যেগুলি হৃদরোগের সৃষ্টি করে)।


কুশিং সিনড্রোমের প্রধান কারণগুলি কি কি?
এই রোগ হওয়ার প্রধান কারণ হল বেশি মাত্রায় কর্টিসল ব্যবহার, বিশেষতঃ গ্লুকোকর্টিকোয়েডস ঘনঘন ব্যবহার করা। কর্টিসল নিম্নলিখিত কিছু কারণে খুবই প্রয়োজনীয়:

  • রক্তের চাপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখে
  • প্রদাহজনক শারীরিক অসুবিধাগুলি কমিয়ে রাখে
  • খাদ্যকে শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তিতে পরিবর্তিত করে


যাইহোক, এর অসামঞ্জস্য শরীরে কর্টিসলের মাত্রাকে অস্বাভাবিক করে তোলে যা ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি করে। এটি অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক প্রকারের হতে পারে (দীর্ঘ সময় ধরে কর্টিকোস্টেরয়েডস সেবন করা)।

অন্যান্য কারণগুলি হল:

  • পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার
  • এক্টোপিক টিউমার যা এসিটিএইচ হরমোন উৎপাদন করে
  • আড্রিনাল গ্রন্থিতে টিউমার


কুশিং সিনড্রোম কিভাবে নির্ণয় করা হয়?

  • মূত্র পরীক্ষা: দিনের বিভিন্ন সময়ের মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে কর্টিসল লেভেল নির্ণয় করে কুশিং ডিজিজ শনাক্ত করা যায়।
  • কর্টিসল ব্লাড টেস্ট: রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেও কুশিং ডিজিজ শনাক্ত করা যায়। তবে এই পরীক্ষায় কেবল রক্ত নেয়ার সময়কার কর্টিসলের মাত্রা প্রকাশ পায়।
  • কর্টিসল স্যালিভা টেস্ট: স্যালিভা বা লালা পরীক্ষার মাধ্যমেও কুশিং ডিজিজ শনাক্ত করা যায়।
  • সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই: কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিংয়ের মাধ্যমে টিউমারের অবস্থান নির্ণয় করে রোগটি শনাক্ত করা সম্ভব।
  • কর্টিকোট্রপিন রিলিজিং হরমোন টেস্ট: এ পরীক্ষায় ব্যক্তির শরীরে CRH প্রবিষ্ট করে দেখা হয় কর্টিসল নিঃসৃত হচ্ছে কি না। যদি কর্টিসল নিঃসৃত হয় তবে ধরে নেয়া হয় ব্যক্তির কুশিং ডিজিজ আছে।
  • পেট্রোসাল সাইনাস স্যাম্পল: এ পরীক্ষায় প্রথমে সাইনাস ক্যাভিটির মাধ্যমে পিটুইটারি থেকে আগত রক্ত এবং এরপর গাইড ক্যাথেটারের মাধ্যমে পিটুইটারি থেকে সরাসরি সংগৃহীত রক্তের মধ্যে তুলনা করা হয়। সাইনাস ক্যাভিটির মাধ্যমে আগত রক্তে কর্টিসলের মাত্রা বেশি পাওয়া গেলে তা মস্তিষ্কে অ্যাডেনোমার উপস্থিতি নিশ্চিত করে।


কুশিং সিনড্রোমের চিকিৎসা পদ্ধতি:

  • পিটুইটারি গ্রন্থি অপসারণঃ কুশিং ডিজিজ নিরাময়ে সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন করা গেছে পিটুইটারি গ্রন্থি অপসারণের মাধ্যমে। কুশিং ডিজিজের টিউমারটি যদি পিটুইটারি গ্রন্থির ভেতরেই আবদ্ধ থাকে, এবং তা মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশ ছড়িয়ে না পড়ে, সেক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে গ্রন্থিটিকে অক্ষত টিউমারটি অপসারণ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে পুনরায় টিউমার হবার সম্ভাবনা প্রায় ৮৫ শতাংশ হ্রাস পায়।
  • অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অপসারণঃ কিছু রোগীর ক্ষেত্রে টিউমার পিটুইটারি গ্রন্থিতে আবদ্ধ না থেকে মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। সেসব ক্ষেত্রে পিটুইটারি গ্রন্থি অপসারণ করে খুব একটা ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে কর্টিসল হরমোন ক্ষরণকারী অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অপসারণের মাধ্যমে ইতিবাচক ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, কর্টিসল মানবদেহের জন্য অত্যাবশকীয় একটি হরমোন। তাই অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অপসারণের পর রোগীকে সারাজীবন কর্টিসল জাতীয় সিন্থেটিক হরমোনের উপর নির্ভর হয়ে থাকতে হয়।
  • রেডিওসার্জারিঃ এ প্রক্রিয়ায় এমআরআই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে টিউমারটির সঠিক অবস্থান নির্ণয় করে সেখানে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নিক্ষেপ হয়। এই চিকিৎসা অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী এবং মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থির ওপর এর তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পড়ে বলে জানা গেছে।
  • পিটুইটারি ডিরেক্টেড ড্রাগসঃ কুশিং ডিজিজের জন্য দায়ী টিউমার যে শুধু অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে কর্টিসল নিঃসরণে উদ্দীপ্ত করে তা-ই নয়, এটি নিজেও প্রোল্যাকটিন ক্ষরণ করে। পিটুইটারি ডিরেক্টেড ড্রাগগুলো গ্রন্থিতে অবস্থিত টিউমারটিকে আক্রমণ করে এবং প্রোল্যাকটিন ক্ষরণ কমিয়ে দেয়। এই ওষুধগুলোর মধ্যে bromocriptine, cabergoline এবং pasireotide উল্লেখযোগ্য। এদের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমন: আঙ্গুলে অসাড়ভাব, নাক থেকে পানি পড়া, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া প্রভৃতি।
  • অ্যাড্রেনাল ডিরেক্টেড ড্রাগসঃ এই ওষুধগুলো কর্টিসলের মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে। তবে পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমারের ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলতে না পারায় দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় এদের খুব একটা ব্যবহার করা হয় না। অ্যাড্রেনাল ডিরেক্টেড ড্রাগের মধ্যে রয়েছে ketoconazole এবং metyrapone। এগুলো সেবনে মাথা ঘোরানো, অজ্ঞান হওয়া, বমি বমি ভাব, ঘন ঘন মূত্রত্যাগের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
  • গ্লুকোকর্টিকয়েড রিসেপ্টর ডিরেক্টেড ড্রাগসঃ এই ওষুধগুলো কর্টিসল সংযোগকারী গ্লুকোকর্টিকয়েড রিসেপ্টরের ওপর ক্রিয়া করে। ফলে CRH এবং ACTH এর নিংসরণ হ্রাস পায়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগ করে বিশেষ ফল পাওয়া গেছে।


নিজের যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি:

  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া।
  • ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করা, কারণ এই অভ্যাসগুলি রোগটিকে আরো জটিল করে তোলে।
  • সুষম আহার করুন, দরকার হলে খাদ্যতালিকা বিশারদের পরামর্শ নিন।
  • নিয়মিত হালকা শরীরচর্চা করুন, কারণ কষ্টকর ও কঠিন ধরণের শরীরচর্চায় বা খেলাতে এই রোগে আক্রান্তদের হাড় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • ধকল ও মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকুন, কারণ বেশি চাপের মধ্যে থাকলে কর্টিসল বেশি ক্ষরণ হয়।


উপরের নিয়মগুলি মেনে চললে কুশিং বর্ণিত রোগ বা কুশিং সিনড্রোমের প্রভাব আয়ত্তের মধ্যে রাখা যায় এবং দরকার মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে