আমাশয় কি?
আমাশয় (ইংরেজি: Dysentery) মানব অন্ত্রে রোগজীবাণুর সংক্রমণজনিত রোগ। সাধারণত এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা (Entamoeba histolytica) কিংবা শিগেলা (Shigella) গণভুক্ত ব্যাকটেরিয়া মানবদেহের পরিপাক তন্ত্রে সংক্রমণ করলে এই রোগ হয়। অন্ত্রের সংশ্লিষ্ট অংশে প্রদাহের সৃষ্টি হয়, পেট ব্যথা করে এবং শ্লেষ্মা ও রক্তসহ পাতলা পায়খানা হতে থাকে। আমাশয় হলে পেট কামড়ানোসহ মলের সঙ্গে পিচ্ছিল আম অথবা শ্লেষ্মাযুক্ত রক্ত যায়।

আমাশয়ের প্রকারভেদঃ
আমাশয় দুই ধরনের হয়ে থাকে। এদের সংক্রমণের কারণ ভিন্ন, রোগের লক্ষণ ভিন্ন এবং চিকিৎসাও ভিন্ন।

  • অ্যামিবাঘটিত আমাশয়ঃ অ্যামিবা বা Entamoeba histolytica জীবাণুর মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। অ্যামিবাঘটিত আমাশয় বড় ছেলে-মেয়েদের হয়ে থাকে কিন্তু ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এর প্রবণতা অত্যন্ত কম৷ পরিপাকতন্ত্রের বৃহদান্ত্রে এন্ট্যামিবা হিস্টোলাইটিকা নামক পরজীবীর সংক্রামণের ফলে এই রোগ হয়৷
  • বেসিলারি আমাশয়ঃ শিগেলা নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা অন্ত্রের সংক্রমণের কারণে হয়। এ রোগটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক হারে দেখা যায় এবং বহু লোকের মৃত্যুর জন্য এই রোগ দায়ী৷ শিগেলার চারটি প্রজাতির মধ্যে Shigella flexneri নামক প্রজাতিটির মাধ্যমে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে আমাশয় ছড়ায়। এটি সবচেয়ে বেশি ছড়ায় জীবাণুবাহী আধোয়া হাত দিয়ে। জীবণুবাহী মাছি ও খাবারের মাধ্যমেও ছড়ায়। মলের সঙ্গে রক্ত বেশি যায় বলে এটিকে এক সময় রক্ত আমাশয় বলা হতো।


আমাশয়ের প্রধান কারণগুলি কি কি?
জীবাণুঘটিত ও পরজীবীঘটিত সংক্রমণের মাধ্যমে এই রোগটি হয়ে থাকে।
আমাশয় সাধারণত দূর্বল সেনিটেশন দ্বারা সৃষ্টি হয়। যেমন -

  • দূষিত খাদ্য
  • দূষিত জল এবং অন্যান্য পানীয়
  • সংক্রামিত লোকদের দ্বারা হাত ধোয়া
  • দূষিত জলে সাঁতার কাটা, যেমন হ্রদ বা পুল
  • শারীরিক যোগাযোগ।


শিগেলা (Shigella) নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ব্যাসিলারি আমাশয় হয়। তাছাড়া ক্যাম্পিলোব্যাক্টর, সালমোনেলা বা এন্টারোহেমোরিজিক ই কোলি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে আমাশয় হয়।

আর অ্যামিবিক আমাশয়টি একটি এককোষী পরজীবীর কারণে সৃষ্টি হয়। বৃহদান্ত্রে অ্যান্টামিবা হিস্টোলাইটিকা নামক পরজীবীর সংক্রমণের ফলে এই রোগ হয়ে থাকে।

শিশুদের মধ্যে বেসিলারি আমাশয় এর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু যে কোনও বয়সে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে।

আমাশয়ের প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
আমাশয় বেশিরভাগই অস্বাস্থ্যকর বা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের জন্য হয়ে থাকে, বিশেষকরে গ্রামাঞ্চলে এবং শহুরে বস্তি এলাকাগুলিতে। মাঝে মাঝে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পানির মতো মল বা পায়খানা দ্বারা এই রোগটি বোঝা যায়। যে উপসর্গগুলি একজন মানুষ সাধারণভাবে অনুভব করতে পারেন সেগুলি হল:

  • পানির মতো অথবা পাতলা মল
  • মলে বা পায়খানাতে আম এবং রক্ত দেখা দেওয়া
  • মল বা পায়খানা করার সময় ব্যথা অনুভব করা
  • জ্বর
  • বমি বমি ভাব
  • বার বার মল ত্যাগ বা পায়খানা করতে যাওয়া।

যদি এই রোগের চিকিৎসা না করা হয় তাহলে কোলনগত ছিদ্রে আলসার সৃষ্টি করে যা কিছু ক্ষেত্রে মলাশয়ে দেখা দিতে পারে।

আমাশয় এবং ডায়রিয়ার পার্থক্য কি?
অনেকেই আমাশয় এবং ডায়রিয়াকে একই ধরনের মনে করে।আবার অনেক সময় বুঝতেই পারেনা যে আসলে তার ডায়রিয়া হয়েছে নাকি আমাশয়। তাই আমাদের জানতে হবে কিভাবে আমরা সহজেই বুঝতে পারব যে কোনটা ডায়রিয়া আর কোনটা আমাশয়।

  • একদিনে তিনবার বা তার অধিক সময় পানির মতো পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলা হয়। আর আমাশয় হলে পেট ব্যাথার সাথে সাথে বারবার শ্লেষা বা রক্তযুক্ত পায়খানা হয়।
  • ডায়রিয়া হলে পেট ব্যাথা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কিন্তু আমাশয় হলে তলপেটের দিকে ব্যাথা হয়।
  • ডায়রিয়া হলে সচরাচর জ্বর আসে না। আমাশয় হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্বর আসে।


আমাশয় কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
কিছু সাধারণ ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়, যেমন-

  • মল পরীক্ষা এবং তার মাইক্রোবিয়াল কাল্চার
  • ইমিউনোক্রমাটোগ্রাফিক ডিপস্টিক পদ্ধতির মাধ্যমে
  • যদি মলের সাথে রক্ত পরতে থাকে তাহলে এন্ডোস্কপির মাধ্যমে


আমাশয়জনিত পাতলা পায়খানার জন্য ওরস্যালাইন ব্যবহার করতে হবে। ব্যাকটেরিয়াজনিত আমাশয়ে ৭ দিন অ্যান্টিবায়োটিক-সিপ্রোফ্লকসাসিন বা এজিথ্রোমাইসিন আর অ্যামিবিক আমাশয়ে মেট্রনিডাজল ৫ দিন সেবন করতে হয়।

আমাশয় এমন একটি অসুখ, যা থেকে মুক্ত থাকতে চাইলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু সাধারণ নিয়ম পালন করলেই চলে। তাই ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিচ্ছন্নতার প্রতি সবার নজর রাখা অতীব জরুরি এ ব্যাপারে।

আমাশয় প্রতিরোধে করনিয়ঃ
সাধারণত জীবাণু দেহের ভেতরে প্রবেশ করার ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই রোগের উপসর্গ প্রকাশ পেতে শুরু করে। এক সপ্তাহের মধ্যেই এটি নিরাময় হয়ে যায়। রোগ সচেতনতা গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই আমাশয় থেকে দূরে থাকা সম্ভব। এজন্য নিম্নলিখিত অভ্যাসগুলো গড়ে তুলতে হবে।

  • প্রতিবার মল ত্যাগের পরে হাত সাবান দিয়ে ভালো করে পরিস্কার করা।
  • স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করা।
  • না ধুয়ে কোনো ফল বা অন্যান্য খাবার না খাওয়া।
  • খাবার খোলা না রাখা।
  • বাসি, পচা কোনো খাবার না খাওয়া।
  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে খাবার প্রস্তুত করতে না দেওয়া।



শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে