ওটিটিস মিডিয়া (কানের সংক্রমণ) কি?
কানের ভিতরে বা বাইরে যেকোনো অংশে সংক্রমণজনিত প্রদাহকে ওটিটিস বলে। আর কানের মধ্যকর্ণে সংক্রমণজনিত প্রদাহকে বলা হয় ওটিটিস মিডিয়া বা Middle Ear Infection. গলবিলের সাথে মধ্যকর্ণের সংযোগ স্থাপনকারী ইউস্টেশিয়ান নালিটি অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে, শুধু ঢোক গেলার সময়ে খোলা থাকে। কোনো কারণে কোনো জীবাণু এ নালি দিয়ে এসে মধ্যকর্ণে প্রদাহ সৃষ্টি করলে তাকে ওটিটিস মিডিয়া বলে। বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।

ওটিটিস মিডিয়ার প্রকারভেদঃ
স্থায়িত্বের ভিত্তিতে ওটিটিস মিডিয়া দুরকম হয়ে থাকে। এগুলো হলো-

  • স্বল্পস্থায়ী বা অ্যাকিউট ওটিটিস মিডিয়াঃ ইউস্টেশিয়ান নালির মাধ্যমে মধ্যকর্ণ কন্ঠনালি ও নাকের সঙে যুক্ত থাকে এবং বায়ু ও তরল পদার্থকে মধ্যকর্ণে প্রবেশ ও ত্যাগে সাহায্যে করে।কিন্তু এ তরল যদি ইউস্টেশিয়ান নালির ভেতর আটকা পড়ে যায় এবং কোনোভাবে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস এ সংক্রমিত হলে মধ্যকর্ণ উত্তেজিত হয় ও পুঁজে ভরে যায়। তখন কানে প্রচন্ড ব্যথাযুক্ত অবস্থাকে অ্যাকিউট ওটিটিস মিডিয়া বলে। দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে এ যন্ত্রণাময় অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসে।
  • দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক ওটিটিস মিডিয়াঃ কর্ণপ্রদাহের চিকিৎসা করা হোক বা নাহোক, দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে যদি সংক্রমণ না সরে তাহলে প্রদাহ দীর্ঘস্থায়ি হয়, এ অবস্থাকে ক্রোনিক ওটিটিস মিডিয়া বলে। এর ফলে কানের পর্দা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং সংক্রমণ মধ্যকর্ণের আশপাশে ছড়াতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করালে কানের পর্দা ফুটো হয়ে যেতে পারে। শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া কানের ভেতরে জমে থাকা তরল আঠালো হয়ে মধ্যকর্ণের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট করে দিতে পারে। এ রোগ হলে শিশুদের কানে ব্যথা হয়, কান টানতে থাকে, অতিরিক্ত কান্নাকাটি করে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, পুঁজ পড়ার কারণে কান ভেঁজা থাকে এবং বিশ্রী গন্ধ হয়। আর বয়স্কদের ক্ষেত্রে কানে চাপ লাগে ও ব্যথা হয়, ভোঁ ভোঁ শব্দ করে।


ওটিটিস মিডিয়ার প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
ওটিটিস মিডিয়া হচ্ছে বিশেষ করে শিশুদের শ্বাসনালির উপরের অংশ এর সংক্রমণজনিত একটি অসুখ। বিভিন্ন ধরনের ওটিটিস মিডিয়া থাকলেও পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। ওটিটিস মিডিয়ার লক্ষণগুলো হলোঃ

  • কান চুলকানো ও জোরে কান টানা
  • অতিরিক্ত কান্নাকাটি
  • লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা
  • ঘুমএ ব্যাঘাত
  • জ্বর আসা
  • প্রচন্ডরকম এর মাথাব্যথা করা
  • ক্ষুধামান্দ্য
  • কাশি
  • নাক দিয়ে পানি ঝরা
  • কান ব্যথা ও কানে চাপ অনুভব করা
  • কান ভোঁ ভোঁ করা বা গুন-গুন ধ্বনি শোনা
  • বমি বা ডায়রিয়া
  • কানের পর্দাফেটে গেলে পিনা গড়িয়ে তরল পদার্থ নির্গমন
  • দেহের ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা
  • এবং শ্রবণ সমস্যা (শ্রবণশক্তি হ্রাস থেকে বধিরতা)।

শিশুদের উপসর্গগুলি কাছ থেকে নজর রাখা দরকার, যেহেতু তারা বড় বাচ্চাদের মত কার্যকরভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম নাও হতে পারে।

ওটিটিস মিডিয়ার প্রধান কারণগুলি কি কি?
সাধারণ ঠান্ডা লাগা কখনও কখনও মধ্য কানের মিউকাস তৈরি করতে সাহায্য করে, এবং তাই ইউস্টেশিয়ান নালি (একটা পাতলা টিউব যেটা মধ্য কানের থেকে নাকের পিছনে চলে যায়) ফুলে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু মিউকাস সঠিকভাবে বেরিয়ে যেতে পারে না তাই সংক্রমণটি সহজেই মধ্য কানে ছড়িয়ে পড়ে। নিম্নলিখিত কারণে ওটিটিস মিডিয়া হয়ে থাকে-

  • প্রধানত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা ছত্রাকের সংক্রমণে এ রোগ হয়।
  • মধ্যকর্ণের সাথে নাকের সংযোগস্থল ফুলে বন্ধ হয়ে গেলে এ রোগ হয়।
  • কোনো কারণে অ্যাডিনয়েড ফুলে গেলেও এ রোগ হয়।
  • মাতৃদুগ্ধ পান না করালে বা কম পান করালেও এই রোগ হতে পারে।
  • শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে ঠান্ডা লাগলে এবং কানের সংক্রমণ হলে এ রোগটি হয়।


ওটিটিস মিডিয়া কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
বেশিরভাগ ওটিটিস মিডিয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হয় না, যেহেতু এটা কিছুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তবে, যদি উপসর্গগুলি আরো খারাপ হয় তবে একটি অটোস্কোপ ব্যবহার করে প্রায়ই মধ্য কান ইনফেকশন নির্ণয় করা হয়। ডাক্তার মধ্য কানের তরল উপস্থিতির লক্ষণগুলির জন্য অটোস্কোপ ব্যবহার করে কান পরীক্ষা করেন যা সংক্রমণের নির্দেশ করে। টাইমপ্যানোমেট্রি, অডিওমেট্রি এবং সিটি /এমআরআই স্ক্যানগুলির মতো আরও পরীক্ষাগুলি শুধুমাত্র তখনই প্রয়োজন হয় যখন চিকিৎসা কার্যকর না হয় বা জটিলতাগুলি বিকাশ হয় এবং সাধারণত কান, নাক এবং গলা (ইএনটি) চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা পরিচালিত হয়।

ওটিটিস মিডিয়া প্রতিরোধের উপায় কি?
ওটিটিস মিডিয়া যেহেতু শিশুদের অসুখ হিসেবে পরিচিত তাই দেশের ভবিষ্যত বংশধরদের নিরোগ দেহ কামনায় উদগ্রীব থাকাটাই স্বাভাবিক।

  • এ রোগে আক্রান্ত হলে ধূমপান এড়িয়ে চলতে হবে (নিজের ক্ষেত্রে) বা শিশুকে অন্যের ধূমপানের আওতামুক্ত রাখতে হবে
  • বায়ুদূষণ থেকে দূরে থাকতে হবে
  • নিজেকে ও শিশুকে অনাক্রম্য করে রাখতে হবে
  • এক বছর বা তারও বেশি কাল পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে
  • বোতলে দুধ খাওয়াতে হলে শিশুকে উলম্ব অবস্থায় খাওয়াতে হবে
  • কানের পাশে সেঁক দিতে হবে
  • বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথা ও জীবাণুনাশক ওষুধ বা কানের ড্রপ ব্যবহার করতে হবে
  • যারা ঘনঘন এ অসুখে ভুগে তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা টিমপেনোস্টোমি টিউব (tympanostomy tube) নামে বিশেষ নালীর সাহায্যে বিশেষ চিকিৎসা করে থাকেন।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে