ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাদ্যাভ্যাস বিকার কি?
খাবার মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। সুস্থ খাদ্যাভ্যাস আপনার জীবনের সুস্থতার অন্যতম চাবিকাঠি। খাদ্যাভ্যাসের অতিরিক্ত সচেতনতা অনেক সময় মানসিক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাকে ইটিং ডিজঅর্ডার বলে।

ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাদ্যাভ্যাস বিকার অনিয়মিত খাওয়ার অভ্যাসের থেকে হয় যার অন্তর্গত হলো বেশী খাওয়া বা কম খাওয়া। রোগীর মধ্যে ধীরে ধীরে এই অভ্যাস বাড়ে, তাই ইটিং ডিজঅর্ডারের বিষয়ে সবার জানা জরুরি।

ইটিং ডিজঅর্ডারের প্রকারভেদঃ
ইটিং ডিজঅর্ডার মূলত তিন প্রকার।

  • অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা
  • বুলিমিয়া নার্ভোসা
  • বিনজ ইটিং ডিজঅর্ডার।


ইটিং ডিজঅর্ডারের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলো কি কি?
ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাদ্যাভ্যাস বিকার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে এবং সময়মত চিকিৎসা করলে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সেইজন্য অবশ্যই ইটিং ডিজঅর্ডারের সাধারন লক্ষণ ও উপসর্গগুলো লক্ষ রাখা জরুরী।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একেকজন একেকভাবে এই সমস্যার দিকে এগিয়ে যায়। যদি কেউ ইটিং ডিজঅর্ডারে ভোগে, তাহলে পরিবর্তনটা প্রথমেই চোখে পড়বে-

  • আক্রান্তের খাবার এবং ব্যায়ামের রুটিনে আমূল পরিবর্তন আসবে। অনেকে ব্যায়াম ছাড়া শুধু ডায়েট করেই স্লিম থাকতে চান, তাদের ইটিং ডিজঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে।
  • যদি কেউ খুব কম সময়ের মধ্যে অনেক বেশি ওজন কমিয়ে ফেলে, কিংবা নিজের দৈহিক গঠন নিয়ে সব সময় খুব চিন্তায় থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সে এই সমস্যায় ভুগছে।
  • ওজন বাড়ার ভয়ে সে তার খাবারের তালিকা থেকে হয়তো পুরো একটি খাবরের বিভাগ বাদ দিয়ে দিতে পারে, যেমন দুধ ও দুগ্ধজাত যে কোনো খাবার কিংবা সব ধরনের মাংস।
  • রেস্তোরাঁয় সবাই মিলে খেতে যাওয়ার সময় সে অনীহা প্রকাশ করবে, খাবার সংক্রান্ত সব ব্যাপারে তার আগ্রহ কম থাকবে।
  • মাথা ঝিমঝিম করা, শীত শীত লাগা, সহজেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, মন খারাপ হওয়া, বিরক্তি বোধ করা এবং হতাশাও ইটিং ডিজঅর্ডারের লক্ষণ।
  • সামাজিক মেলামেশা না করা বা একা থাকা।
  • বুলিমিয়া, যেখানে রোগী ঘনঘন প্রচুর পরিমান খাবার খায়।
  • খিদে না পেলেও খাওয়া।
  • মেজাজ পরিবর্তন।


ইটিং ডিজঅর্ডারের প্রধান কারনগুলো কি কি?
ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাদ্যাভ্যাস বিকার নানা কারনে হতে পারে। যাইহোক, কিছু সাধারন কারন নীচে বলা হলো:

  • বংশগত কারনে- কিছু মানুষের জিনগত কারনে এই সমস্যা হতে পারে। নিকট আত্মীয়দের বিশেষ করে বাবা-মা, ভাইবোনের মাঝে যদি এই সমস্যা থাকে তবে সেই ব্যক্তির আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।
  • মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কারনে- ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক সমস্যা থাকে। তারা সাধারণত কম আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, আবেগ প্রবন আচরণ, ত্রুটিপূর্ণ সম্পর্ক, দেহের আকার আকৃতি ও অতিরিক্ত ওজন নিয়ে রসিকতার সম্মুখীন,পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে থাকে। যার ফলে ধীরে ধীরে এইসব আচরনের কারনে তাদের মাঝে ইটিং ডিজঅর্ডারের প্রবণতা দেখা দেয়।
  • সমাজ ব্যবস্থা- জনপ্রিয় সমাজ ব্যবস্থায় সাফল্য ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সর্বত্রই জিরো ফিগারের জয় জয়কার। কর্মক্ষেত্রের ঊর্ধ্বস্তনদের চাপে এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখে অনেকেই ক্ষীণকায় হবার আশায় এতে আক্রান্ত হোন। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অথবা কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির চাপ সামাল দিতে গিয়েও হতে পারে।
  • হঠাৎই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন।


ইটিং ডিজঅর্ডার কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
যদি উপরোক্ত কিছু লক্ষণ বা উপসর্গগুলো দেখা দেয়, তাহলে এটা একটা ইঙ্গিত চিকিৎসককে দেখানোর। আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গের, খাদ্যাভাসের, এবং রোজের জীবনযাপন সম্বন্ধিত প্রশ্নের উপর নির্ভর করে, চিকিৎসক নির্ণয় করেন যে ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাদ্যাভ্যাস বিকার আছে কিনা।

সনাক্তকরণের সময়, তিনি আক্রান্ত ব্যক্তিকে শারীরিক পরীক্ষা করবেন এবং যদি দরকার পরে তাহলে ল্যাবোরেটরিতে কিছু পরীক্ষা করাতে পারেন, আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার মূল্যায়ণ করেন ও একজনের মধ্যে কতটা পৌষ্টিক অভাব সেটা ঠিক করেন।
চিকিৎসক সাইকোলজিকাল তদন্ত চালান সঠিক সনাক্তকরণের জন্য।

ইটিং ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা একটু সময় সাপেক্ষ তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময় যোগ্য। সেক্ষেত্রে অবশ্যই আক্রান্ত ব্যক্তির ভালো হওয়ার ইচ্ছে থাকতে হবে এবং তাকে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সহায়তা করতে হবে।এই রোগের চিকিৎসায় সাধারণত শারীরিক সমস্যা সমাধানের সাথে সাথে মানসিক অবস্থাও মনিটর করা হয়।

  • আক্রান্ত রোগীদের কখনো তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে ব্লেম করা যাবে না। তুমার ওজন এত কম কেনো? তুমি কি খাও না? ইত্যাদি কথা তাদের মানসিক অবস্থা কে আরো খারাপ করে তুলে, তাই ব্লেম নয়,এপ্রিশিয়েট করতে হবে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির নিজেকে সাহায্য করার বই, স্বাস্থ্য পরিচর্যাকারীর ও থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে হবে।
  • রোগীর অবস্থার গুরুত্বের উপর নির্ভর করে সম্পর্ক ভিত্তিক বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ত্ব দেয় এমন থেরাপি নিতে হবে ।
  • ডায়েট কাউন্সেলিং- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস মেনে চলার জন্য ডায়েট কাউন্সেলিং করতে হবে।
  • পারিবারিক থেরাপি- ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ কিভাবে তাদের উপর এবং তাদের পরিবারের উপর প্রভাব ফেলে তা আলোচনা করার থেরাপিও নিতে হবে।


ইটিং ডিজঅর্ডার রোগটি নিরাময় যোগ্য কিন্তু এটা নির্ভর করে রোগীর অবস্থার উপর।কারন আক্রান্ত ব্যক্তির যত দ্রুত শনাক্ত হবে তত দ্রুত তারা সেরে উঠবে। তাই যখনি কোন ব্যক্তির মাঝে এর লক্ষণ প্রকাশ পায় দেরি না করে সাথে সাথে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সাথে একজন ভালো ডায়েটিশিয়ান ও সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাউন্সেলিং এ রাখতে হবে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে