ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা বা ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স কী?
মানব দেহ একটি জটিল এবং সুবিন্যস্ত কোষ, পেশী এবং তরলের সমন্বয়ে গঠিত জৈব সত্ত্বা। যা সর্বক্ষণ বৈদ্যতিক শক্তি উৎপাদন করে। শরীরে কোষ, পেশী ও তরল পদার্থ সঞ্জীবনী শক্তিতে ক্রিয়া সম্পাদন করে এবং প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। মানব দেহের এসব কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি আসে ইলেকট্রোলাইটের মাধ্যমে।

হোমিওস্ট্যাসিস বা বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপে সমতা বজায় রাখার জন্য মানব দেহে কয়েক প্রকারের খনিজ বা ইলেক্ট্রোলাইট দরকার পড়ে। শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটগুলির ভারসাম্য ঠিক না থাকলে স্নায়ু, হরমোন এবং শরীরের তরল পদার্থের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স (দেহে খনিজ অসমতা) মানে হলো শরীরে সোডিয়াম, ক্লোরিন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং পটাসিয়ামের মতো এক বা একাধিক ইলেক্ট্রোলাইট বা খনিজের মাত্রারিক্ত উপস্থিতি অথবা ঘাটতি।

মানব দেহে প্রধানত: সাত রকমের ইলেকট্রোলাইটের কার্যকারিতা দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

  • সোডিয়াম
  • ক্লোরাইড
  • পটাশিয়াম
  • ম্যাগনেশিয়াম
  • ক্যালশিয়াম
  • ফসফরাস
  • বাইকার্বনেট।


ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতার প্রধান লক্ষন ও উপসর্গগুলো কি কি?
ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতার প্রধান লক্ষন ও উপসর্গগুলো হলো:

  • শরীরে পানির অভাব
  • দূর্বলতা এবং পেশীতে খিঁচ ধরা
  • মাথাব্যথা, মাথাঘোরা এবং ঝিমুনি
  • বিভ্রান্তি বোধ
  • খিঁচুনি
  • মানসিক অবসাদ
  • রক্তচাপে পরিবর্তন
  • হৃদস্পন্দনে অসুবিধা
  • গোটা শরীরে ফোলাভাব
  • হাড়ের সমস্যা
  • মূত্র উৎপাদনে পরিবর্তন।


ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতার প্রধান কারণ কি কি?
ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স (দেহে খনিজের অসমতা)-এর প্রধান কারণগুলি হলো:

  • ডায়রিয়া, বমি, অত্যধিক ঘাম, গুরুতর সংক্রমণ, অ্যান্টিডাইইউরেটিক হরমোনের সমস্যা ইত্যাদির কারণে শরীরে পানির অভাব।
  • অ্যাল্ডোস্টেরন (অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত) এবং প্যরাথাইরয়েড হরমোনের কাজকর্মে বিকার, এই দু’টির সঙ্গেই শরীরে সোডিয়াম ও ক্যালসিয়ামের যোগ রয়েছে।
  • কিডনি কাজকর্মে বিকৃতি হলে তার থেকে শরীরে থাকা ইলেক্ট্রোলাইটগুলি অস্বাভাবিক মাত্রায় বেরিয়ে যায় অথবা জমা হয়।
  • রক্তচাপের (ডাইইউরেটিক) চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ।
  • কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর, ফুসফুসে সমস্যা ইত্যাদি।


ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
চিকিৎসক ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স (দেহে খনিজের অসমতা) ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষার সাহায্যে নির্ণয় করেন।

রক্ত পরীক্ষাঃ রক্তে ইলেক্ট্রোলাইট বেড়েছে না কমেছে, রক্তের pH মাত্রা, কিডনির কাজকর্ম ইত্যাদি সনাক্ত করার জন্য সিরাম বা রক্তরসে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি পরিমাপ করতে বেসিক মেটাবলিক প্যানেল ব্যবহার করা হয়।

প্রস্রাব পরীক্ষাঃ এটা ব্যবহার করা হয় প্রস্রাবে ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স (দেহের খনিজ অসমতা)-এর মাত্রা পরিমাপ করতে।

অন্যান্য পরীক্ষা - এগুলো করা হয় ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স (দেহের খনিজ অসমতা)-এর কারণের উপর নির্ভর করে

  • সিরাম ক্রিয়েটিনিন, রক্তে ইউরিয়া নাইট্রোজেন
  • প্যারাথাইরয়েড হরমোনের মাত্রা
  • হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের সমস্যার জন্য ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম, ২ডি ইকো, এক্স-রে চেস্ট ইত্যাদি করা হয়।


ভারসাম্যের অভাব ঠিক করার জন্য নিম্নলিখিত চিকিৎসাগুলি করা হয়:

  • ইঞ্জেকশন অথবা খাওয়ার ওষুধের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোলাইট সম্পূরক দেওয়া হয়।
  • পটাসিয়ামের মতো ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ তাজা ফল খেতে বলা হয়।
  • পেশীতে খিঁচ, মাথাব্যথা, বমিভাব, ইত্যাদি থেকে উপশমের জন্য উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা।
  • ওডেমা বা শরীর ফোলার ক্ষেত্রে পানি খাওয়ার পরিমান কম করা হয়।
  • ওডেমা কমাতে ডাইইউরেটিকের মতো ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
  • কর্টিকস্টেরয়েডস অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি সম্পর্কিত অসুখের কারণে ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স (দেহে খনিজের অসমতা) হয়।


ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য:
ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন ইলেকট্রোলাইট মাত্রারিক্ত হলে যেমন ক্ষতি হয়। তেমনি ঘাটতি হলেও ক্ষতি হয়। পৃথিবী ব্যাপী আজকে সোডিয়ামের ভারসাম্যহীনতার কারণে উচ্চরক্তচাপ এবং হৃদরোগের প্রার্দূভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম নয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা হবে এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে