ফাইব্রোমায়ালজিয়া কি?
ফাইব্রোমায়ালজিয়া একটি দীর্ঘমেয়াদী যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক অসুস্থতা, যার প্রধান উপসর্গ হচ্ছে মাংসপেশী, টেন্ডন এবং অস্থিসন্ধিগুলোতে প্রদাহ হওয়া। ফাইব্রোমায়ালজিয়ায় শরীরের সমস্ত পেশী আক্রান্ত হয়। যাঁদের এই রোগ নেই তাঁদের তুলনায় যেসব ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত, তাঁরা সাধারণত যন্ত্রণার প্রতি বেশি সংবেদনশীল হন। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী সহস্রাধিক মানুষ এই রোগটিতে আক্রান্ত হয়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ এই রোগে আক্রান্ত এবং পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার প্রায় সাতগুণ বেশি। ফাইব্রোমায়ালজিয়া যেকোনো বয়সে হতে পারে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়তে থাকে।

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি?
যেসব উপসর্গগুলি বেশিরভাগ হয়, সেগুলি হলো:

  • যন্ত্রণা, সারা শরীরে ব্যথাভাব এবং শরীর আড়ষ্ঠ (শরীরকে নড়ানো বা বাঁকা করা যায় না) হয়ে যায়, বিশেষ করে নির্দিষ্ট কিছু জায়গাতে
  • আলস্য ভাব
  • ভালো করে ঘুমোতে না পারা
  • প্রচণ্ড মাথাব্যথা বা যন্ত্রণা
  • মহিলাদেড় প্রচণ্ড মাসিকের ব্যথা
  • হাত পা অসাড় হয়ে যাওয়া এবং ঝিঁঝিঁ ভাব
  • স্মৃতিশক্তির সমস্যা
  • বিষন্ন বোধ করা বা ডিপ্রেশনে চলে যাওয়া
  • শারীরিক অসামর্থ্যতা
  • খিটখিটে স্বভাব
  • হাত ও হাতের আঙুল ফুলে যাওয়া এবং ঝিনঝিন করা
  • পেটে কামড়ানো ব্যথা
  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
  • কোনো কানে বেশি শোনা
  • ঘন ঘন ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়া
  • পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই সবচেয়ে বেশি এই অবস্থার সম্মুখীন হন এবং আক্রান্ত মহিলাদের সকালে ক্লান্তি ভাব, সারা শরীরে যন্ত্রণা, এবং অস্বস্তিকর পেটের সমস্যা, এই সব উপসর্গগুলি উপলব্ধি করেন।

ফাইব্রোমায়ালজিয়া রোগে এমন সব উপসর্গ দেখা যায়, যা সাধারণত চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। রোগের শুরুর দিকে ব্যথা এক জায়গায় থাকলেও আস্তে আস্তে দুই হাত, দুই পা, পিঠ ও ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে সকালের দিকে রোগীরা চরম অবসাদগ্রস্ততায় ভোগে। কাজের ক্ষেত্রে কেউ কেউ চরম অসুবিধার সম্মুখীন হয়, এমনকি ব্যথা আর অবসাদের কারণে কেউ কেউ আগেভাগে অবসরে চলে যেতে বাধ্য হয়। ব্যথানাশক ওষুধেও সাধারণত প্রতিকার হয় না। এ ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি দিলে ব্যথা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার প্রধান কারণগুলি কি?
এই অবস্থাটির সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি, যদিও বলা হয় যে জিগনগত কারণে এই রোগটি হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের তুলনায় বেশি এবং দ্রুত যন্ত্রণার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়তে পারেন। এই অবস্থার প্রধান কারণগুলি হলো:

  • হরমোন পরিবর্তন
  • মানসিক চাপের ভিন্ন মাত্রা
  • জলবায়ু পরিবর্তন


ফাইব্রোমায়ালজিয়া কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
এ রোগের বিস্তারিত ইতিহাস জেনে এবং শারীরিক পরীক্ষার মধ্যে ফাইব্রোমায়ালজিয়া টেন্ডার পয়েন্টস নামে শরীরের ১৮টি ব্যথাপ্রবণ জায়গায় ব্যথার মাত্রা দেখে রোগ নির্ণয় সম্ভব। উপসর্গগুলি বেশিরভাগ সময় এই অবস্থার একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সাধারণত দরকার হয় না, যদি না শরীরের ব্যথা বা অলস ভাব অন্য কোনও কারণে হয়ে থাকে। এই অবস্থা বোঝার জন্য রোগীর অনেক বছর সময় লেগে যেতে পারে। রক্ত পরীক্ষা এবং এক্স-রে করে তেমন কিছু ধরা পড়ে না, তবে অন্যান্য রোগ থেকে আলাদা করার জন্য এগুলো করা জরুরি।

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার চিকিৎসা কি?
একজন ফিজিয়াট্রিস্ট বা ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থেকে এ রোগের চিকিৎসা নিলে রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ রোগের চিকিৎসার তিনটি মূল লক্ষ্য রয়েছে। তাহলো-

  • রোগীকে এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনকে তার রোগ সম্পর্কে জানানো, বোঝানো এবং রোগের প্রকৃতি ও চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার জন্য একজন মনোবিদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
  • ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সাধারণত ট্রিপটিন, প্রিগাবালিন ও গাবাপেনটিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া কিছু অ্যারোবিক এক্সারসাইজ, যেমন- সাঁতার কাটা, দৌড়ানো, হাঁটা এবং নিয়মিত যোগব্যায়াম অন্যতম।
  • ভালো ঘুমের জন্য স্লিপ হাইজিন মেনে চলা, যেমন- শুধু ঘুম পেলেই ঘুমাতে যাওয়া, প্রতিদিন একই সময় ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা, ঘুমানোর কমপক্ষে চার-ছয় ঘণ্টা আগে থেকে ব্যায়াম না করা এবং চা-কফি না খাওয়া, ঘুমের নিয়মনীতি তৈরি করা ও মেনে চলা, যৌন মিলন ব্যতীত শুধু ঘুমের জন্যই বিছানা ব্যবহার করা, ঘুমানোর আগে কিছু হালকা খাবার খাওয়া, ঘুমানোর ৯০ মিনিট আগে একটা হট-বাথ নেওয়া এবং বিছানা ও শোবার ঘর শান্ত-নিরিবিলি এবং আরামদায়ক কি না, তা নিশ্চিত করা।


আমাদের দেশেই এ রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে যে কেউ এ রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা নিতে পারবে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে