ফুড পয়জনিং কি?
ফুড পয়জনিং এমন একটি অবস্থা যা দূষিত খাবার খাওয়ার কারণে বা দূষিত পানি পান করার কারণে হয়ে থাকে। খাবারটি ক্ষুদ্র জীবাণু, ক্ষুদ্র পোকা, বা এরকম কোনো প্যাথোজেন বা জীবাণুর দ্বারা দূষিত বা বিষাক্ত হতে পারে। সব সময় খাবার থেকেই যে ফুড পয়জনিং হবে এমন কোনো কথা নেই। যে পাত্রে খেতে দেবেন সে সেটিও জীবাণুমুক্ত হতে হবে, তা নাহলেও ফুড পয়জেনিং হতে পারে।

এটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে, কিন্তু সবথেকে বেশি প্রভাব গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল পদ্ধতি বা পরিপাক ক্রিয়ার উপর পরে। যদি সময়মতো এর চিকিৎসা করা না হয়, তবে এ থেকে পানিশূন্যতা হতে পারে। কিডনি অকেজো হয়ে পড়তে পারে। শরীরের যেকোনো অঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে। অনেক সময় এটি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ফুড পয়জনিং এর প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
ফুড পয়জনিংএর সাধারণ উপসর্গগুলি হল:

  • বমি বমি ভাব
  • বমি
  • জ্বর
  • ডায়রিয়া
  • পেটে ব্যথা
  • পেট ভরা ভরা ভাব
  • ক্ষুধামান্দ্য
  • ব্যক্তিটির খুব কাঁপুনি হতে পারে, মাথা ঘোরা, এবং প্রচন্ড পরিমাণে ঘাম হতে পারে।
  • যে জীবাণুটি এই অবস্থা সৃষ্টি করার কারণ তার উপর নির্ভর করে যে, দূষিত বা বিষাক্ত খাবারটি খাওয়ার বা পানীয় পান করার সঙ্গে সঙ্গেই উপসর্গগুলি দেখা দেবে, নাকি কিছুদিন পরে দেখা দেবে।


ফুড পয়জনিং এর প্রধান কারণগুলি কি কি?

  • যে কোনো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, বা পরজীবী খাবার বা পানিকে দূষিত করতে পারে এবং সেই খাবার খাওয়া বা পানীয় পান করার ফলে ফুড পয়জনিং হতে পারে।
  • খাদ্যদ্রব্য অস্বাস্থ্যকরভাবে উৎপাদনের কারণে, ভুল ভাবে রান্না করা, প্রক্রিয়াকরণ, বা প্যাকেজিং এর কারণে খাবার দূষিত হতে পারে।
  • বাসি-পচা, অস্বাস্থ্যকর ও জীবাণুযুক্ত খাবার এবং অনেকক্ষণ গরমে থাকার ফলে নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার খেলে ফুড পয়জনিং হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
  • সাধারণত যে ব্যাকটেরিয়াগুলি ফুড পয়জনিং এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল প্রক্রিয়ায় অস্বস্তি সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে রয়েছে, সালমনেলা টাইফি, ভিব্রিয়ো কলেরা, ক্লোসট্রিডিয়াম ডিফিসিল, স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস, এবং ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার।
  • রোটাভাইরাস এবং হেপাটাইটিস এ ভাইরাসও খাদ্যকে দূষিত করতে পারে।
  • দূষিত পানি হলো ফুড পয়জনিং হওয়ার অন্যতম বড় কারণ। এটি ড্রেনের ময়লা পানির সঙ্গে পরিষ্কার পানি মিশে যাওয়ার ফলে, পানি ঠিকমতো পরিশুদ্ধ না করার ফলে, বা পানি পরিবহন ব্যবস্থা সঠিক না হওয়ার ফলে হতে পারে।
  • খাবারের জন্য ব্যবহৃত থালাবাটি ভালোভাবে না ধোয়ার ফলে এ সমস্যা হতে পারে।
  • খাওয়ার আগে হাত ভালো করে না ধুলেও এই সমস্যা হতে পারে।
  • গরম বা অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরের ভেতরে পানির চাহিদা বেড়ে যায়। এ জন্য অনেকেই রাস্তার তৈরি শরবত খেয়ে ফেলে। এ থেকে ফুড পয়জনিং হতে পারে। কেননা, রাস্তাঘাটের খাবার বেশির ভাগ সময় পরিষ্কার থাকে না।


ফুড পয়জনিংয়ে ঘরোয়া করণীয় কি?
ফুড পয়জনিং সমস্যায় প্রধান করণীয় হচ্ছে প্রচুর পানি পান করা। শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া খনিজ প্রতিস্থাপন করতে ওরস্যালাইনও খেতে হবে। সম্ভব হলে ডাবের পানিও পান করুন। এছাড়া আরো যা করবেন-

  • পাকস্থলিকে শান্ত করতে প্রথম কিছু ঘণ্টা খাবার খাবেন না।
  • পেট শান্ত হয়েছে মনে হলে খাবার খেতে পারেন। অল্প খাবার দিয়ে শুরু করুন।
  • মসলাদার বা চর্বিযুক্ত খাবার থেকে দূরে থাকুন। এসময় ব্লান্ড ডায়েটের ওপর থাকুন, যেমন- ভাত, টোস্ট ও কলা।
  • এসময় দুধ জাতীয় খাবার, ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয়, অ্যালকোহল ও বুদবুদ ওঠে এমন পানীয় এড়িয়ে চলুন।
  • কায়িক শ্রম থেকে বিরত থাকুন। প্রচুর বিশ্রাম নিন।
  • পাতলা পায়খানা বন্ধ করতে ওটিসি মেডিসিন সেবন করবেন না। প্রাকৃতিক নিরাময় প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ডায়রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে জীবাণু বের হয়ে যেতে দিন।


ফুড পয়জনিং নির্ণয় কিভাবে করা হয়?
ফুড পয়জনিং নিম্নলিখিত উপায়ে নির্ণয় করা হয়:

  • ফুড পয়জনিং আপনার উপসর্গগুলির উপর ভিত্তি করে, এবং সম্প্রতি আপনি যা খেয়েছেন তার একটি বিস্তারিত ইতিহাস জেনে তারপর নির্ণয় করা হয়।
  • কোন প্যাথোজেন বা জীবাণুটি এই বিষক্রিয়াটি ঘটিয়েছে তা জানতে, স্টুল কালচার বা মলের পরীক্ষা করা হয়।
  • রক্ত পরীক্ষাও সংক্রমণের কারণটির ইঙ্গিত দিতে পারে, যদি সংক্রমণ হয়ে থাকে তাহলে রক্তে শ্বেত কণিকার মাত্রা (ডাবলুবিসিএস) বেশি থাকবে। হেপাটাইটিস ভাইরাস সনাক্ত করতে নির্দিষ্ট রক্ত পরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে।


কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
সাধারণত ফুড পয়জনিং নিজে নিজে নিরাময় হলেও কিছু লক্ষণ দেখলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত, যেমন-

  • মুখ শুকিয়ে যাওয়া অথবা অতিরিক্ত পিপাসা।
  • প্রস্রাব না হওয়া অথবা খুবই গাঢ় রঙের প্রস্রাব।
  • দ্রুত হৃদস্পন্দন অথবা রক্তচাপ কমে যাওয়া।
  • মাথা ঘোরানো অথবা মস্তিষ্কে দুর্বলতা/হালকা হয়ে যাওয়া।
  • বিভ্রান্তি
  • বমি বা মলে রক্ত
  • তিনদিনের বেশি পাতলা পায়খানা
  • অসহনীয় পেট ব্যথা বা মোচড়ানো
  • খুব বেশি জ্বর হলে
  • খাবার বা পানি মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি
  • বাহুতে ঝিনঝিন করা
  • মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যাওয়া।


ফুড পয়জনিং এর চিকিৎসা কি?

  • ফুড পয়জনিং এর চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে উপসর্গগুলিকে সারিয়ে তোলা এবং বিষক্রিয়ার কারণটিকে নির্মূল করা।
  • শরীর থেকে নির্দিষ্ট প্যাথোজেন বা জীবাণুটি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। জীবাণুটির উপর নির্ভর করে, নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক নির্ধারণ করা হয়। জীবাণুগুলি শরীর থেকে সম্পূর্ণ ভাবে দূর করতে, অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্সটি ডাক্তারের পরামর্শ মতো সম্পূর্ণ করা খুব প্রয়োজন।
  • ফ্লুইড রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি এবং ইলেক্ট্রোলাইটসের মাধ্যমে পানিশূন্যতার চিকিৎসা করা হয়। ওরাল রিহাইড্রেশন ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ তাই প্রচুর পরিমানে পানি, লেমনেড বা সরবৎ, তাজা রস, ডাবের পানি বা ঘোল পান করা উচিত।


ফুড পয়জনিং প্রতিরোধের উপায় কি?

  • রাস্তার খোলা খাবার খাবেন না।
  • বেশি পিপাসা পেলে ডাব খেতে পারেন।
  • পানি ফুটিয়ে খেতে হবে।
  • বাসন-কোসন ভালোভাবে ধুতে হবে।
  • খাওয়ার আগে হাত ভালো করে ধুতে হবে।
  • দুধ, কলা, ফলমূল বেশি দিন পুরোনো হয়ে গেলে খাবেন না।
  • গরমের সময় হোটেলের খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কেননা, অনেক হোটেলেই স্বাস্থ্য-সচেতনতার বিষয়টি লক্ষ রাখা হয় না।
  • যতটা সম্ভব টাটকা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। কয়েক দিন ধরে ফ্রিজে রাখা আছে এমন খাবার খাওয়াও ঠিক না।
  • খাবার ঠিকমতো ঢেকে রাখুন, নয়তো বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ খাবারে বসে জীবাণু ছড়াতে পারে।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে