এন্ডোমেট্রিওসিস কী?
এন্ডোমেট্রিয়াম, জরায়ুর সবচেয়ে ভিতরের স্তর, মাসিক চক্রের সময় রক্তের সাথে অপসারিত হয়ে যায়। এই স্তরটি ডিম্বাশয়ের হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের প্রতি সংবেদনশীল হয়। নয় থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স অবধি মহিলাদের জরায়ুতে যে এন্ড্রোমেট্রিয়াল লাইন থাকে, তার কোষ জরায়ুর বাইরে ফেলোপিয়ান টিউব, ডিম্বাশয় বা পাউচ অব ডগলাসে লেপ্টে বসে থাকলে তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলে। এটি একটি খুবই যন্ত্রনাদায়ক অবস্থা এবং কখনও কখনও এতটাই গুরুতর হয়ে যায় যে এর ফলে শ্রোণী অঞ্চলের অঙ্গগুলি একে অপরের সাথে লেপ্টে যায়।

সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সামাজিক অবস্থান, আর্থিক পরিস্থিতি বা বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রোগ সীমাবদ্ধ নয়। এখনও মেনোপজ হয়নি, এমন যে কোন মহিলার এই রোগটি হতে পারে। এন্ডোমেট্রিওসিস কোনও সংক্রমণ নয়, ছোঁয়াচে রোগও নয়।

এন্ডোমেট্রিওসিসের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
ঋতুচক্রের সময়ে এন্ডোমেট্রিয়াম যেমন ফুলে ওঠে, তেমনই বাইরে (ফেলোপিয়ান টিউব, ডিম্বাশয় বা পাউচ অব ডগলাস)এ সব অঙ্গের উপরে রক্তভরা পিণ্ড তৈরি হয়। এন্ডোমেট্রিওসিসের উপসর্গগুলো নির্ভর করে কোন এলাকায় এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যুগুলি সৃষ্টি হয়েছে তার উপর। এন্ডোমেট্রিওসিসের কিছু সাধারণ উপসর্গ নিচে উল্লেখ করা হল-

  • তলপেট ও পেলভিসে ব্যথা। ঋতুস্রাবের শুরুর দিন চারেক আগে থেকে যন্ত্রণাদায়ক ঋতুস্রাব শুরু হওয়া। আবার কারও কারও প্রবল রক্তপাত হতে পারে।
  • যৌন মিলনের সময় বা পরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়।
  • মাসিক চক্রের সময় অস্বাভাবিকভাবে প্রচুর (মেনোরেজিয়া) বা দীর্ঘকালীন (মেট্রো্রেজিয়া) রক্তপাত।
  • কোমর, তলদেশ বা শ্রোণিচক্রে এক টানা ব্যথা চলতেই থাকে। এই পেলভিক পেইন যথেষ্ট কষ্টদায়ক।
  • সন্তানধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারন, এই রোগ হলে মেনস্ট্রুয়াল প্যাটার্নে পরিবর্তন হয়। অনেকের বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত এসে যায়।
  • মুত্রত্যাগের সময় ব্যথা অনুভব ও মলত্যাগের সময় ব্যথা অনুভব করা। এই পথে অস্বাভাবিক রক্তপাতও হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে।
  • অবসাদ (বিশেষ করে মাসিক চক্রের সময়)।

এই রোগ এক জন নারীর সাধারণ স্বাস্থ্য ভেঙে দেয়। সহজে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ও অনেকেই ক্লান্তি, হতাশায় ভুগতে শুরু করেন। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এমন অনেক মহিলা আছেন যাঁরা জীবনে কখনও এমন কোন উপসর্গ অনুভব করেননি, অথচ পরীক্ষা করলে তাঁদের এন্ডোমেট্রিওসিস ধরা পড়েছে।

এন্ডোমেট্রিওসিসের প্রধান কারণগুলো কি কি?
এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু যখন ডিম্বাশয়ে, ফেলোপিয়ান টিউবে, বা শ্রোণী অঞ্চলের অন্য কোন অঙ্গে সৃষ্টি হতে শুরু করে তখন এন্ডোমেট্রিওসিস হয়। এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে:

  • যখন মাসিক চক্রের রক্ত বাইরে না বেরিয়ে ভিতরে প্রত্যাবর্তন করে এবং ফেলোপিয়ান টিউবে বা ডিম্বাশয়ে ফিরে যায় (বিপরীত গতি), তখন ফেলোপিয়ান টিউবে বা ডিম্বাশয়ে এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ জন্মাতে শুরু করে।
  • অপারেশনের ফলে প্রতিস্থাপন – সিজারিয়ান পদ্ধতিতে প্রসবের কালে অপারেশন বা হিস্টারোস্কোপিতে, এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু শ্রোণী অঞ্চলের অঙ্গে জন্মাতে পারে।
  • পেরিটোনিয়াল কোষের পরিবর্তন – কিছু্ রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত জটিলতা বা হরমোনগত কারণে, পেরিটোনিয়াল কোষ এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যুতে পরিবর্তিত হয়।
  • এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ অপসারণ – এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ অন্য কোনো অঙ্গে পৌঁছাতে পারে রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে।
  • এম্ব্রায়োনিক কোষের রূপান্তর – বয়ঃসন্ধিকালে, ইস্ট্রোজেনের কারণে, এম্ব্রায়োনিক কোষ এন্ডোমেট্রিয়াল কোষে রূপান্তরিত হয়।


কোথায় এন্ডোমেট্রিওসিস রোগের প্রকোপ দেখা যায়?

  • ওভারি বা ডিম্বাশয়ের উপরে লেপ্টে বসে থাকা ছোট রক্তভরা থলি বা সিস্ট তৈরি হতে পারে। একে চকোলেট সিস্ট বলে।
  • যোনিপথ বা মলদ্বারের মাঝে হতে পারে, যাকে রেক্টো ভ্যাজাইনাল এন্ডোমেট্রিওসিস বলে।
  • পেরিটোনিয়ামেও হতে পারে। এটি এক ধরনের ঝিল্লি যা পেটের ভিতরের সব অঙ্গকে ঢেকে রাখে।
  • মূত্রথলি, পায়ু বা বাওয়েলে এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সময়ে প্রস্রাবের সঙ্গে পায়ুদ্বার দিয়েও রক্তপাত হতে পারে। তবে এটি খুব কম হয়।
  • জরায়ুর পেশির দেওয়ালেও এই সমস্যা হতে পারে। একে অ্যাডিনোমায়োসিস বলে।
  • বিরল তবু শরীরের অন্যান্য অংশে যেমন নাভি বা ফুসফুসেও হতে পারে। তবে এর সংখ্যা খুব কম।


কারা এন্ডোমেট্রিওসিস রোগের ঝুঁকিতে আছেন?

  • ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারী।
  • যাঁদের সন্তান হয়নি বা বন্ধ্যত্ব আছে।
  • যাঁরা প্রথম সন্তান দেরিতে নিয়েছেন।
  • এ রোগের পারিবারিক ইতিহাস।


এন্ডোমেট্রিওসিস কিভাবে নির্ণয় করা হয় ও এর চিকিৎসা কি?
সম্পূর্ন চিকিৎসাগত ইতিহাস ও সম্পূর্ণ শারীরিক পরীক্ষা (শ্রোণী অঞ্চলের পরীক্ষাও এর অন্তর্গত) সাধারণত এন্ডোমেট্রিওসিস সনাক্তকরণে সাহায্য করে। তা সত্ত্বেও, কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় নির্ণয়টিকে নিশ্চিত করতে এবং এই রোগ কতটা ছড়িয়েছে তা দেখার জন্য:

  • শ্রোণী অঞ্চলের আল্ট্রাসাউন্ড – এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু শ্রোণী অঞ্চলের কোন অঙ্গে বাসা বেঁধেছে কি না তা উদ্ঘাটন করে।
  • ট্রান্সভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসনোগ্রাফি – এই পরীক্ষার মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু শ্রোণি অঞ্চলের কোন অঙ্গে বাসা বেঁধেছে তা জানা যায়, বিশেষ করে ডিম্বাশয়ের চকোলেট সিস্ট ডায়াগনসিস আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমেই সম্ভব।
  • ল্যাপারোস্কপি – এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু এন্ডোস্কোপির সাহায্যে দেখা হয় ও তার সাথে বায়েপসি করে নির্ণয়টিকে নিশ্চিত করা হয়।
  • ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) – এন্ডোমেট্রিয়াল যে স্থানটিতে সৃষ্টি হয়েছে সেটির অবস্থান নির্ণয় ও এর আকৃতি নির্ণয় করতে সাহায্য করে।


এন্ডোমেট্রিওসিসের চিকিৎসা পদ্ধতি:
এন্ডোমেট্রিওসিসের বিভিন্ন চিকিৎসা রয়েছে। তবে চিকিৎসায় এই রোগ পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায় না। এটি একটি রিকারেন্ট ডিজিজ; অর্থাৎ বারবার হতে পারে। তাই দুই ডিম্বাশয়সহ ইউটেরাস ফেলে দেওয়াই এর কার্যকর চিকিৎসা। এটি যাদের বয়স কম এবং বাচ্চা নেই বা ফ্যামিলি সম্পূর্ণ হয়নি, তাদের জন্য সম্ভব নয়। তবে নিয়ম মেনে নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করলে রোগটি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে থাকে। ওষুধ ও অপারেশন—এই দুই পদ্ধতিতে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়।

ওষুধ : এন্ডোমেট্রিওসিসের অন্যতম চিকিৎসা মাসিক বন্ধ করে রাখা। এটি ওষুধ সেবনের দ্বারা সম্ভব। কিছু পেইনকিলার দিয়ে মাসিকের ব্যথা প্রশমিত করা যায়। তাতে যদি কাজ না হয়, তাহলে বিভিন্ন হরমোন প্রয়োগ করে মাসিক বন্ধ করে রাখা হয়। ফলে ব্যথাও হয় না এবং ধীরে ধীরে রোগটি সেরে ওঠে, সিস্ট ছোট হয়ে যায়। জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও স্বল্প খরচের চিকিৎসা। এ ছাড়া আরো বিভিন্ন চিকিৎসা রয়েছে; তবে এই পদ্ধতির সমস্যা হলো এগুলো জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে। এতে রোগের উপশম হয়; কিন্তু চিকিৎসা চলাকালে বাচ্চা হওয়া সম্ভব নয়।

সার্জারি : যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত হয়, সেগুলো ধীরে ধীরে টিউমারের আকার ধারণ করতে পারে। তখন তা অপারেশনের মাধ্যমে ফেলে দিতে হবে। অপারেশন দুই রকম।
রক্ষণশীল : যেখানে সিস্ট ছাড়ানো হয় এবং অ্যাডহেসন ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।
ডেফিনিটিভ : দুই ওভারি ও জরায়ু ফেলা দেওয়া হয় (যাদের বয়স বেশি এবং বাচ্চা আছে তাদের জন্য প্রযোজ্য।

বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা : যাদের এন্ডোমেট্রিওসিস আছে তাদের ৫০ শতাংশেরই সন্তান হতে অসুবিধা হয়। এদের চিকিৎসা হলো রক্ষণশীল অপারেশন। পেট কেটে বা ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে এটা করা যায়, তবে ল্যাপারোস্কপিই উত্তম চিকিৎসা পদ্ধতি।

এতে সন্তান না হলে টেস্টটিউব চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। রোগ বেশি জটিল পর্যায়ে গেলে অপারেশন না করে সরাসরি টেস্টটিউব চিকিৎসা করা হয়।

এন্ডোমেট্রিওসিস রোগের প্রতিকার কী?

  • যাঁদের উপসর্গ সামান্য বা যাঁদের মেনোপজের সময় আসন্ন, তাঁদের জন্য তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, কেবল নির্দিষ্ট সময় পরপর ফলোআপ করলেই হবে।
  • ব্যথা কমাতে আইবুপ্রফেন, মেফেনোমিক অ্যাসিড ইত্যাদি ব্যথানাশক কাজ করে।
  • একটানা ৬ থেকে ৯ মাস স্বল্প মাত্রার জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা শুধু প্রজেস্টেরন বড়ি দেওয়া হয় অনেক সময়।
  • লেট্রোজল, প্রজেস্টেরন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি একত্রে ছয় মাস খেলে উপকার পাওয়া যায় অনেক সময়।
  • প্রজেস্টেরন বা গোনাডোট্রপিন অ্যানালগ ইনজেকশনও ব্যবহার করা হয়।
  • অনেক সময় ল্যাপারোস্কপি বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অস্বাভাবিক অবস্থানের টিস্যুগুলোকে কেটে বা পুড়িয়ে ফেলা হয়। এটা জটিল অস্ত্রোপচার।
  • যাঁদের বয়স কম ও সন্তান নেননি, তাঁদের এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে সন্তান নেওয়া উচিত, কেননা এ থেকে পরবর্তী সময়ে বন্ধ্যত্ব হতে পারে।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে