গেঁটে বাত বা গাউট কি?
গেঁটে বাত বা গাউট (ইংরেজি: Gout) হচ্ছে একটি প্রদাহজনিত রোগ; এতে সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধি ও এর আশেপাশের টিস্যুতে মনোসোডিয়াম ইউরেট মনোহাইড্রেট ক্রিস্টাল জমা হয়। যেসমস্ত ব্যক্তির রক্তে উচ্চ মাত্রায় ইউরিক অ্যাসিড থাকে তাদের প্রদাহজনক আর্থ্রাইটিসের বিকাশ ঘটে, যা গাউট নামে পরিচিত। এটি ঘন ঘন তীব্র জয়েন্টে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, এবং লালচেভাবের দ্বারা চিহ্নিত করা যায়, যা আকস্মিক এবং রাতারাতি বিকাশ ঘটতে পারে। ইউরিক অ্যাসিড জমে যাওয়ার ফলে জয়েন্টে ছুঁচের মত স্ফটিক গঠন হয়, যার কারণে আকস্মিক ব্যথা হয়। মহিলাদের তুলনায় পুরুষেরা ৫ গুণ বেশি এই রোগে আক্রান্ত হয়। পুরুষরা সাধারণত ৩০ বছরের পর এবং মহিলারা মেনোপজ বা রজোনিবৃত্তির পরে বেশি আক্রান্ত হয়।

গেঁটে বাত বা গাউটের সঙ্গে যুক্ত লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি সাধারণত পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের জয়েন্টকে আক্রান্ত করে। গাউটের সঙ্গে যুক্ত কিছু সাধারণ লক্ষণ এবং উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • সাধারণত একটি জয়েন্টে তীব্র আর্থ্রাইটিস হয়; তবে একসাথে একাধিক জয়েন্ট আক্রান্ত হতে পারে।
  • কঠিনতার পাশাপাশি জয়েন্টে (বিশেষত হাঁটু, পায়ের আঙ্গুল, কনুই এবং হাতের আঙ্গুল) গুরুতর এবং আকস্মিক ব্যথা।
  • আক্রান্ত অংশের উপর গরম ফোলা এবং চামড়া চকচকে লাল হয়ে যায়।
  • জ্বর, কাঁপুনি ও অবসাদগ্রস্ততা থাকতে পারে।
  • খুব দ্রুত ব্যথা শুরু হয়ে ২ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে; প্রায়শই ভোরবেলা রোগীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ব্যথা এতই তীব্র হয় যে রোগী পায়ে মোজা পরতেও পারেনা।
  • ব্যথা কমে গেলে আক্রান্ত স্থান চুলকায় ও চামড়া উঠে যেতে পারে।

কেউ কেউ একবার আক্রান্ত হবার পর দ্বিতীয়বার আর আক্রান্ত হয় না; তবে অনেকেই কয়েক বছরের মধ্যে আবার আক্রান্ত হতে পারে। কেউ কেউ এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়ে পড়ে তারা ক্রনিক গাউটে আক্রান্ত হতে পারে এতে করে জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা আছে। জয়েন্ট ও এর আশেপাশের টিস্যুতে ক্রিস্টাল জমা হয়ে নডিউল বা দলা তৈরি করতে পারে যাকে টোফাস ( বহুবচনে টোফাই) বলে। টোফাসে ঘা হতে পারে, সংক্রমণ হতে পারে, প্রদাহ হয়ে পুঁজ বের হতে পারে। ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর রোগীদের ক্ষেত্রে ১২ মাসের মধ্যে টোফাস হতে পারে। দীর্ঘদিন রক্তে ইউরিক এসিড লেভেল বেশি থাকলে কিডনিতে পাথর হতে পারে।

গেঁটে বাত বা গাউটের প্রধান কারণগুলি কি কি?
রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অস্থিসন্ধিতে মনোসোডিয়াম ইউরেট মনোহাইড্রেট ক্রিস্টাল জমা হয়ে গাউট রোগ সৃষ্টি করে। রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে তাকে হাইপারইউরিসেমিয়া বলে। হাইপারইউরিসেমিয়ার কারণ নিম্নরূপ:

বৃক্কীয় নিষ্কাশন কমে যাওয়া

  • বৃক্কীয় নালিকায় পুনঃশোষণ বৃদ্ধি।
  • রেনাল ফেইলিউর।
  • সীসা বিষক্রিয়া।
  • ল্যাকটিক এসিডোসিস।
  • অ্যালকোহল ( বিশেষত বিয়ার কারণ এতে গুয়ানোসিন নামক পিউরিন বেশি থাকে)।
  • হাইপারকিটোএসিডেমিয়া (ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস, দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত থাকা)।
  • ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস(ভেসোপ্রেসিন রেজিস্টান্ট)।
  • বার্টার সিনড্রোম।
  • ওষুধ। যেমন: থিয়াজাইড ও লুপ ডাইউরেটিকস, স্বল্পমাত্রার অ্যাসপিরিন, সাইক্লোসপরিন, পাইরাজিনামাইড


ইউরিক এসিড উৎপাদন বৃদ্ধি

  • মায়েলোপ্রলিফারেটিভ ও লিম্ফপ্রলিফারেটিভ ডিজিজ ( লিউকেমিয়া রোগে কেমোথেরাপি নেয়ার সময় ইউরিক এসিড লেভেল অনেক বেড়ে যায়।)"
  • সোরিয়াসিস।
  • বেশি ফ্রুক্টোজ গ্রহণ।
  • গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ।
  • বংশগত রোগঃ লেস নাইহান সিনড্রোম( এক্স-লিংকড্ রিসেসিভ রোগ)।
  • ক্রনিক হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া।
  • কার্সিনোমা ও সারকোমা।
  • সাইটোটক্সিক ড্রাগস।


গেঁটে বাত বা গাউট কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
চিকিৎসক উপসর্গগুলির বিস্তর ইতিহাস নিতে পারেন, এবং একটি শারীরিক পরীক্ষা করতে পারেন। এর নির্ণয় করাকে সাহায্য করতে কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষাও করা হয়:

  • সিরাম ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা নির্ধারণ করার জন্য রক্ত পরীক্ষা।
  • এক্স-রে।
  • জয়েন্টের মধ্যে তরলে দ্রুত স্ফটিকের গঠনকে সনাক্ত করার জন্য আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান।
  • নরম টিস্যু বা কলা এবং হাড়ের পরীক্ষা করার জন্য কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি (সিটি/CT) বা ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই/MRI)।


গাউটের চিকিৎসা নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে হয়:

  • প্রসারণের কারণে হওয়া ব্যথার পরিচালনা
  • প্রসারণের চিকিৎসা করার জন্য ননস্টেরয়েডাল এন্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (এনএসএআইডিস/NSAIDs) ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে ইবুপ্রোফেন, স্টেরয়েড, এবং এন্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ কোল্চিসিন।


ভবিষ্যতের প্রসারণগুলিকে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে প্রতিরোধ করা হয়:

  • খাদ্য এবং জীবনধারায় পরিবর্তন করে
  • অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে
  • মদ্যপান এড়িয়ে চলে
  • পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার (লাল মাংস যেমন গরু, ভেড়া, ছাগলের মাংস বা অর্গ্যান মাংস) এড়িয়ে চলে
  • হাইপারইউরিসেমিয়ার সঙ্গে যুক্ত ওষুধগুলি পরিবর্তন করে অথবা বন্ধ করে (যেমন, ডিউরেটিক)


ইউরিক অ্যাসিড কমানোর এজেন্টের ব্যবহার

  • অ্যালোপিউরিনল
  • ফেবুক্সস্ট্যাট
  • পেগলোটিকেস


গাউট বা গেঁটে বাত থেকে বাঁচতে কি খাবেন?

  • রুটি বা পরিমিত ভাত।
  • দুধ (ননীমুক্ত)।
  • ফল (বিশেষত: চেরি)।
  • পেঁপে (কাঁচা পেঁপে অর্ধ – সেদ্ধকরে)।
  • সবজি।
  • মিঠা পানির মাছ।
  • পুদিনা পাতার রস।
  • তেঁতুলের শরবত এবং প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধপানি।

আমরা কত দিন বাঁচব, তার উপর আমাদের কোন হাত নেই। তবে সুস্থ থাকাটা অনেকাংশে আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবন-যাপন পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। কাজেই সচেতন হন, যে কটা দিন বাঁচবেন, জীবনকে উপভোগ করে বাঁচুন।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে