মাথায় উকুন কি?
উকুন একটি পরজীবী প্রাণী। যেটি মাথার চুলের ভেতর বাসা বাঁধে। এতে মাথা সারাক্ষণ চুলকাতে থাকে। এ ছাড়াও বেশ অস্বস্তিকর এবং বিরক্তিকর ব্যাপারও বটে। পুরুষের তুলনায় নারীদের চুলে উকুন বেশি দেখা যায়।

আবার শিশুদের জন্যও এটি আরো অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ বড়দের মতো তারা নিজের যত্ন নিজেরা যেহেতু নিতে পারে না। তাই বাবা-মায়েদের জন্য এটি দুশ্চিন্তার কারণ।

উকুন আসলে এক ধরনের পোকা। যা মাথার ত্বক, ঘাড় এবং চুলের সঙ্গে লেগে থাকে। এদের খাবার হচ্ছে মানুষের রক্ত। একটি তিল বীজের সমান এদের আকার হয়ে থাকে। মাত্র ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ডিম পারে এরা। মানুষসহ গরম রক্তবিশিষ্ট যে কোনো স্তন্যপায়ী এবং পাখি উকুনে আক্রান্ত হয়।

মাথায় উকুনের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
যদি কারোর স্ক্যাল্পে উকুন থাকে তবে এটি চিহ্নিত করা বা খুঁজে বের করা খুব কঠিন, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে যখন উকুন নিকী বা ডিম পর্যায়ে থাকে। মাথায় উকুন হলে যেসব লক্ষন দেখা যায় তা হলো-

  • মাথায় চুলকানি; মাথা উকুন আসার তিন চার সপ্তাহ পরে সবচেয়ে বেশি চুলকানি হয়।
  • উকুনের কামড়ের দাগ খুবই অস্পষ্ট, সহজে দেখা যায় না।
  • বেশি চুলকালে আক্রান্ত স্থানে ঘা হতে পারে, যা পরে জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।
  • এছাড়া উকুন দ্বারা 'লাউস-বর্ন-টাইফাস', 'লাউস-বর্ন-রিল্যাপসিং ফিভার' বা 'ট্রেঞ্চ ফিভার' নামক রোগ হতে পারে।


মাথায় উকুনের প্রধান কারণগুলি কি কি?
মাথায় উকুন (পেডিকুলাস হিউম্যানাস ক্যাপাইটিস) জন্মায় এবং বেড়ে ওঠে যখন পরিবেশ ও তাপমাত্রা অনুকূল হয়। মাথায় উকুন প্রায়শই একজন মানুষের থেকে অন্যজনের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শে ছড়িয়ে পরে। গবেষণায় দেখা গেছে যে মাথায় উকুন বাচ্চাদের মধ্যে খুব সাধারণ যেহেতু তারা স্কুলে বা খেলার সময়ে অন্য বাচ্চার সংস্পর্শে থাকে।

সংক্রামিত ব্যক্তির পোশাক ব্যবহার করার কারণেও মাথায় উকুন হতে পারে। টুপি এবং স্কার্ফ কারোর সাথে ভাগ করা উচিত নয় এবং সবসময় আলাদা রাখা উচিত।

মাথায় উকুন কিভাবে নির্ণয় করা এবং চিকিৎসা করা হয়?
মাথায় উকুন নির্ণয়ের জন্য কোনো পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয় না। একজন কেবল উকুনের চিরুনি ব্যবহার করে অথবা স্ক্যাল্প পরীক্ষা করেই উকুন নির্ণয়ে নিশ্চিত হতে পারেন।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে পৃথিবীতে উকুনের আক্রমণ বেড়েছে, যা বছরে লক্ষ লক্ষ পর্যন্ত হয়। উকুনের ডিম, বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক উকুন সম্পূর্ণরূপে নিধনের কোনো নিশ্চিত চিকিৎসা নেই। অবশ্য বেশ কয়েক ধরনের চিকিৎসা আছে যেগুলো কিছু পরিমাণে সফলতা দেখায়। সেগুলো হচ্ছে, রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ, প্রাকৃতিক বস্তু ব্যবহার, চিরুনি, চুল কামানো, গরম বাতাস প্রয়োগ এবং সিলিকন ভিত্তিক লোশন।

মাথায় উকুনের চিকিৎসার মধ্যে আছে ঔষধিযুক্ত পণ্য যেমন শ্যাম্পু, তেল এবং অন্যান্য যেগুলি প্রায়ই স্ক্যাল্পে সরাসরি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয় এবং তারপর পণ্যটির উপর নির্ভর করে ধুয়ে ফেলা বা আঁচড়ানো নির্ভর করে। বাজারে সবচেয়ে সাধারণ এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত পণ্যগুলির মধ্যে কিছু উকুন ও তাদের নিকীকে হত্যা করার জন্য আইভারমেক্টিন কনটেন রয়েছে।

বিশেষ ধরণের ঘন দাঁতযুক্ত চিরুনি তৈরী করা হয়েছে যা কেবল সোজাসুজি ভাবে চুল আঁচড়ানোর মাধ্যমে উকুন ও নিকী বের করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

প্রয়োজনীয় সতর্কতাগুলির মধ্যে রয়েছে প্রত্যেকের পোশাক আলাদা রাখা এবং মাথা ও ঘাড়ের চারিপাশে যা ব্যবহার করা হয় তা কারোর সাথে ভাগ না করা যতক্ষন না পর্যন্ত মাথায় উকুনের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হচ্ছে।

উকুন দূর করার ঘরোয়া উপায়ঃ
শুরুতেই উকুনকে প্রতিরোধ না করলে তা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার উকুন মারার জন্য ক্ষতিকারক কেমিক‍্যাল ব্যাবহার করলে তা চুলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই কিছু সহজ উপায় জেনে নিন উকুন দূর করার-

  • নারিকেল তেল: উকুন তাড়ানোর জন্য কিন্তু নারিকেল তেলের কোনো জুড়ি নেই। নারিকেল তেল উকুনের শ্বাসরোধ করতে সাহায্য করে। রাতে ৩ থেকে ৪ চামচ নারিকেল তেল এবং কর্পূর গরম করে তা চুলে এবং মাথার তালুতে ভালো করে লাগাতে হবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শ্যাম্পু করতে হবে। মোটামুটি সপ্তাহে ৫ দিন নিয়ম করে এই পদ্ধতি অনুসরণ করার পর উকুনমুক্ত হতে পারবেন।
  • লেবুর রস: লেবুর রসে আ্যাসিড থাকে যা উকুন তাড়াতে এবং আটকাতে উপযোগী। লেবুর রসের সাথে আদা বেটে সেই মিশ্রণটি চুলে প্রায় আধ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর পানি এবং শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলতে হবে। এই মিশ্রণটি পর পর ৪ থেকে ৫ দিন চুলে লাগালে পুরোপুরি উকুন তাড়ানো যায়।
  • ভিনেগার: উকুনকে প্রতিরোধ করার জন্য ভিনেগার হলো এক মোক্ষম উপায়। ভিনেগারে প্রচুর আসিটিক আ্যাসিড থাকে যা আমাদের চুলে হওয়া উকুনকে মারতে সাহায্য করে। ভিনিগার উকুনের ডিম বা নিটকে আমাদের চুলের থেকে বিলীন করে দেয়। সমান পরিমাণ ভিনেগার আর মিনারেল অয়েল মিশিয়ে ঘুমোনোর আগে তা আমাদের মাথার তালুতে এবং চুলে লাগিয়ে রাখতে হবে। আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে শ্যাম্পু করতে হবে। মোটামুটি সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার এই মিশ্রণটি লাগালে কিছু সপ্তাহের মধ্যেই উকুন থেকে বাঁচা সম্ভব।
  • পেঁয়াজ: পেঁয়াজ একটি খুবই সহজ এবং ঘরোয়া উপায়ে যা দিয়ে উকুন তাড়ানো যায়। কিছুটা পরিমানে পেঁয়াজ বেটে রাখতে হবে। তারপর ছাকনি দিয়ে তার রস বের করেতা আমাদের চুলে এবং মাথার তালুতে লাগাতে হবে। এরপর মাথা ঢেকে তা মোটামুটি ২ ঘণ্টার জন্য রেখে দিতে হবে। সময় হয়ে গেলে মাথায় হালকা গরম পানি এবং শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই পদ্ধতি তা প্রথমে পর পর ৩ দিন অনুসরণ করে তারপর সপ্তাহে একদিন লাগাতে হবে। এইভাবে যতদিন না আমরা পুরো উকুন মুক্ত হচ্ছেন ততদিন মাসে ১ দিন করে লাগাতে হবে।


সতর্কতাঃ

  • একই রেমিডি বা ওষুধ একাধিকবার ব্যবহার করবেন না। ডোজ শেষ হওয়ার পরও যদি উকুন দূর না হয় তবে অন্যটা ব্যবহার করুন।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো কেমিকেল পণ্য ব্যবহার করা উচিত হবে না।
  • উকুনের ওষুধ ব্যবহারের সময় কন্ডিশনার ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। কন্ডিশনার উকুনের খাবার। যা একে আরো বেশি দীর্ঘায়ু দিবে।
  • বড় উকুন মারা যাওয়ার পরও চুলের সঙ্গে এর ডিম লেগে থাকতে পারে। সেগুলোও চিরুনি দিয়ে ব্রাশ করে ফেলে দিন। ডিম থেকে পুনরায় আবার উকুন হতে পারে সন্তানের চুলে।
  • ভেজা চুল বেঁধে রাখবেন না।
  • চুল ও মাথার ত্বক পরিস্কার রাখুন।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে