হিমোফিলিয়া কি?
হিমোফিলিয়া একটি বংশানুক্রমিক জন্মগত রক্তরোগ যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার বিশেষ উপাদান থাকে না। ফলে শরীরের কোনো অংশে আঘাত পেলে বা একবার রক্তনালী কেটে গেলে আর রক্তপাত বন্ধ হয় না। সামান্য কাটা-ছেঁড়ায় সাধারণত খুব বেশি সমস্যা হয় না। কিন্তু দেহের ভেতরে জয়েন্ট, যেমন হাঁটু, কনুই, ইত্যাদির ভিতরে রক্তক্ষরণ হলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

শুধু পুরুষলোক এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং স্ত্রীগণ এই রোগের বাহক, কারণ স্ত্রীদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকে আর পুরুষদের একটি এক্স ও অপরটি ওয়াই ক্রোমোজোম।

হিমোফিলিয়া দু’ধরনের হয়:

  • হিমোফিলিয়া A
  • হিমোফিলিয়া B

ফ্যাক্টর VIII এর অভাবে হিমোফিলিয়া এ (A) এবং ফ্যাক্টর IX এর অভাবে হিমোফিলিয়া বি (B) রোগ হয়।

রাণী ভিক্টোরিয়া হিমোফিলিয়ার বাহক ছিলেন এবং তার বংশে অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হয়, তাই হিমোফিলিয়াকে রাজকীয় রোগও বলা হয়ে থাকে।

সারা পৃথিবীতে প্রতি ১০ হাজার জনে একজন হিমোফিলিয়াসহ অন্যান্য রক্তক্ষরণজনিত রোগে ভুগছে। শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এমন রোগীর সংখ্যা আরো বেশি। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি লাখে ২০ জন মানুষ হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত। তবে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে বংশে এ রোগের ইতিহাস নাও থাকতে পারে।

হিমোফিলিয়ার প্রধান লক্ষন ও উপসর্গগুলো কি কি?
হিমোফিলিয়া স্বাভাবিকভাবে রক্ত তঞ্চনে বাধা দেয়। আঘাত লাগার পর অন্যান্যদের তুলনায় হিমোফিলিয়া রোগীদের দীর্ঘক্ষণ রক্তপাত হতে পারে আর অত্যধিক রক্তপাতের কারণে অনেকসময় রোগীর মৃত্যুও হতে পারে, যদি তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা না করা হয়।

বাইরের রক্তপাতের লক্ষণ-

  • মুখে রক্তপাত
  • সামান্য কেটে গেলেও প্রচুর রক্তপাত
  • নাক দিয়ে রক্তপাত।


ভিতরের রক্তপাতের লক্ষণ-

  • প্রস্রাব ও মলের সাথে রক্ত
  • শরীরের বড়ো পেশীর থেকে রক্তপাতের কারণে দীর্ঘ কালশিটে দাগ
  • কোনও আঘাত ছাড়াই জোড় বা গাঁট থেকে রক্তপাত
  • সামান্য ধাক্কাতে মস্তিষ্কে রক্তপাত অথবা গুরুতর আঘাত।


ছেলে বাচ্চার বয়স সাধারণত এক থেকে দুই বছরের মধ্যেই রোগটি ধরা পড়ে। সামান্য কাটা-ছেঁড়ায় রক্ত বন্ধ হতে চায় না। সামান্য আঘাতে চামড়ার নিচে রক্ত জমে কালচে দাগ পড়ে। পায়খানা-প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

হিমোফিলিয়ার প্রধান কারনগুলো কি কি?
হিমোফিলিয়া আক্রান্তদের শরীরে থ্রম্বোপ্লাস্টিন নামক অভাব দেখা দেয়, যার ফলে এই সমস্ত ব্যক্তিদের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। হিমোফিলিয়াকে এক্স লিঙ্কড ডিজিজ বলে। ছেলেদের একটি মাত্র এক্স ক্রোমোজম ও একটি ওয়াই ক্রোমোজম থাকে তাই ছেলেরাই এই রোগে ভোগে। একটি হিমোফিলিক মেয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জন্মের আগেই মারা যায়।

হিমোফিলিয়া কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
পরীক্ষা

  • রক্তের ফ্যাক্টর দুটির পরীক্ষা।
  • রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতা পরীক্ষা।
  • জিনগত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয় এবং তারপর জেনেটিক কাউন্সিলিং করা হয়।


চিকিৎসা
হিমোফিলিয়া রোগের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই। জেনেটিক কারণে হয় বলে হিমোফিলিয়া সারানো যায় না। যেহেতু, প্রধান লক্ষ্য হলো, জোড় থেকে রক্ত পড়া ও এর জটিলতা রোধ করা, তাই গুরুতর রকমের হিমোফিলিয়া A ও B রয়েছে, এরকম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে জরুরিকালীন চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া দরকার। ধারাবাহিক রক্তপাতের সমস্যায় হিমোফিলিয়া আক্রান্তদের ফ্যাক্টর VII ও ফ্যাক্টর IX রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি প্রয়োজন।

  • রক্ত ও প্লাজমা দাতাদের উন্নতমানের স্ক্রিনিংয়ের ফলাফল নিরাপদ প্লাজমা-আহরক ফ্যাক্টর VII ও ফ্যাক্টর IX কনসেনট্রেটস।
  • হিমোফিলিয়া A আক্রান্তদের ক্ষেত্রে রক্ত পরিব্যাপ্তি বা ব্লাড ট্রান্সফিউশনের জন্য হাতে যে বিকল্প রয়েছে তা বাছার জন্য় ভাইরাল নিরাপত্তা প্রাথমিক মাণদণ্ড হওয়া উচিত।
  • মৃদু থেকে মাঝারি হিমোফিলিয়া A আক্রান্তদের জন্য যখনই উপযুক্ত মনে হবে ডিডিএভিপি ব্যবহার করা উচিত।
  • হিমোফিলিয়া B আক্রান্তদের জন্য় রক্ত তঞ্চনের সহায়তায় বিশুদ্ধ ফ্যাক্টর IX কনসেনট্রেটস ব্যবহার করা উচিত। অন্যান্য ক্ষেত্রে, প্রোথ্রম্বিন কমপ্লেক্স কনসেনট্রেটস ব্যবহার বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
  • অপারেশনের সময় এবং অপারেশনের পর অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় থেরাপিউটিক সামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে, তবেই হিমোফিলিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসক, ব্লাড ব্যাঙ্ক অথবা ওষুধের দোকান, সার্জনের, এবং কোয়াগুলেশন ল্যাবোরেটরি কর্মীর নিবিড় সহযোগিতা দরকার।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে