হরমোনের ভারসাম্যহীনতা (হরমোনের অসামঞ্জস্যতা) কি?
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অকারণেই ক্লান্ত লাগছে? মনে হচ্ছে দুনিয়াটা দুলছে বা রাতে ঘুমের মধ্যে ঘেমে যাচ্ছেন! এসব লক্ষণ হতে পারে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।

মানুষের শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রার গড়বড়কে হরমোনের অসামঞ্জস্যতা (হরমোনের ভারসাম্যহীনতা) বলে। হরমোন হলো একটা রাসায়নিক পদার্থ যেটা আমাদের শরীরের এন্ডোক্রিন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। এটি রক্তের প্রবাহের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় এবং বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গে বার্তা পৌঁছে দেয়, এই ভাবে এটি এদের ক্রিয়ার সমন্বয় করে এবং ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। হরমোন শারীরিক বৃদ্ধি, মেজাজের ওঠানামা, শরীরের তাপমাত্রা, খাবারের বিপাক ইত্যাদিতে প্রভাব ফেলে। হরমোনের ওঠা-নামা অনেকসময় প্রাকৃতিক ভাবে হয় যেমন গর্ভাবস্থার কিছু সময় বা বয়সের সাথে। হরমোনের অসামঞ্জস্যতা অনেকসময় লিঙ্গ এবং প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। হরমোনের পরিবর্তনের সময়মত চিকিৎসা না করানোয় শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে।

হরমোনের ভারসাম্যহীনতার প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলো কি কি?
হরমোনের ভারসাম্যহীনতার প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলো হল:

  • ক্লান্তি।
  • ত্বক পরিবর্তন।
  • রাতে ঘেমে যাওয়া।
  • দুশ্চিন্তা বোধ করা।
  • খিটখিটে মেজাজ।
  • ঘন ঘন মাথাব্যথা
  • বন্ধ্যাত্ব।
  • স্তনের বোঁটা থেকে নিঃসরণ।
  • ওজন বাড়া।
  • বয়স্কদের ব্রণ।
  • হঠাৎ ওজন পরিবর্তন।
  • অনিয়মিত মাসিক।
  • স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া।
  • দূর্বল পেশী ও হাড়।
  • চুল পড়ে যাওয়া।
  • ইন্সমনিয়া (ঘুমের ব্যঘাত)।
  • গরম ঝলক।
  • হতাশা।
  • হাত ও পায়ের পাতা ঠান্ডা থাকা।
  • মেজাজের পরিবর্তন।
  • নিয়মিত পায়খানা না হওয়া।
  • হৃদস্পন্দনে, রক্তচাপ এবং রক্তে সুগারের মাত্রাতে পরিবর্তন দেখা যায়।


হরমোনের ভারসাম্যহীনতার প্রধান কারণগুলো কি কি?
হরমোনের অসামঞ্জস্যতার প্রধান কারণগুলো হলো:

  • মানসিক চাপ।
  • দীর্ঘ ক্লান্তির উপসর্গ।
  • জিনগত পরিবর্তন।
  • কিছু ওষুধ, যেমন স্টেরয়েডস।
  • মেনোপজ।
  • গর্ভাবস্থা।
  • জন্ম নিরোধক ওষুধ।
  • অটোইমিউন অবস্থা।
  • উল্টোপাল্টা খাবার।
  • থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা - হাইপার বা হাইপো থাইরোডিজম।
  • বয়স বৃদ্ধি।
  • কিছু অ্যালার্জি।
  • মেডিক্যাল অবস্থা যেমন পলিসিস্টিক ওভারিয়ান অসুখ, প্রোল্যাক্টিনোমা, গ্রন্থিগুলোর কম বা বেশী ক্রিয়াকলাপ (পিটুইটারী, থাইরয়েড, ওভারিজ, টেস্টেস, অ্যাড্রেনালস, হাইপোথ্যালামাস, এবং প্যারাথাইরয়েড)।


হরমোনের ভারসাম্যহীনতা কিভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
বিশদ ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও, হরমোনের মাত্রায় ভারসাম্যহীনতা সাধারণত স্যালাইভা এবং সিরাম পরীক্ষার দ্বারাই নির্ণয় করা হয়। যৌন হরমোনের যেমন টেস্টোস্টেরন এবং এস্ট্রোজেনের মাত্রা নির্ণয় করার জন্য পরীক্ষা করতে বলা হয়। ইমেজিং স্টাডিস, যেমন আল্ট্রাসাউন্ড বা এম আর আই, করার প্রয়োজন হতে পারে।

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা নিয়ন্ত্রণ করা হয় আসল কারণের চিকিত্‍সা করে এবং নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে চিকিত্‍সা করা হয়।

  • ওষুধ মলম ও প্যাচের মাধ্যমে সিন্থেটিক হরমোন দেওয়া হয়।
  • হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা।
  • হরমোনের ভারসাম্যহীনতার উপসর্গ কম করতে সক্রিয় জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যকর খাবারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
  • যেসব ব্যক্তিদের দুশ্চিন্তা ও হতাশা আছে তাদের দুশ্চিন্তা ও হতাশা কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়।
  • অতিরিক্ত হরমোনের নিঃসরনের ক্ষেত্রে হরমোন অ্যান্টাগোনিস্টস দেওয়া হয়।


হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে করণীয় কি?

  • প্রাকৃতিক উপায়েও হরমোনের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থিগুলোর সক্রিয়তা যাতে অতিরিক্ত বা অতি সামান্য না হয় সেজন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদানের সরবরাহ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। সেখানে থাকতে হবে পর্যাপ্ত প্রোটিন ও ভোজ্য আঁশ আর কমাতে হবে কার্বোহাইড্রেট এবং চিনির পরিমাণ। সেই সঙ্গে হরমোনের উৎপাদন বাড়াতে চাই স্বাস্থ্যকর চর্বি। ‘ক্যাফেইন’ ও দুগ্ধজাত খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ করলে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে। অপরদিকে ‘গ্রিন টি’ শরীরে ‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ সরবরাহের মাধ্যমে ‘ঘ্রেলিন’, ‘ইন্সুলিন’য়ের মাত্রা কমায় এবং শরীরে ‘কর্টিসল’ হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
  • কম কিংবা বেশি খাওয়া: শরীরের চাহিদার তুলনায় কম কিংবা বেশি খাবার খাওয়ার কারণেও হরমোনে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। আর তাই লিঙ্গ, বয়স এবং স্বাস্থ্য বিবেচনা করে ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  • নিয়মিত শরীরচর্চা: ব্যায়াম করলে শুধু শরীর গঠনই হয় না সঙ্গে হরমোনের ভারসাম্যও বজায় থাকে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের মধ্যে থাকলে শরীর সুঠাম হওয়ার পাশাপাশি ঝরবে বাড়তি চর্বি, উৎপাদন বাড়বে প্রদাহরোধক হরমোনের এবং ‘ইন্সুলিন’য়ের সংবেদনশীলতা বাড়বে।
  • মানসিক চাপ সামলান: শরীর যখন চাপে থাকে তখন হরমোনের উৎপাদন প্রক্রিয়াও শৃঙ্খলা হারায়।
  • পর্যাপ্ত ঘুম: ঘুমের অভাব থাকলে মেজাজ খারাপ থাকে, তার পেছনে একটি বড় কারণ হরমোনজনীত সমস্যা। ঘুমানোর সময় শরীর তার বিষাক্ত উপাদান অপসারণ করার সুযোগ পায়, পরের দিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে। আর ঘুম পর্যাপ্ত না হলে সবকাজই অসম্পুর্ণ থেকে যায়। তাই সবকিছুর চাইতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করাকে মূল্যায়ন করা জরুরি।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে