রাতকানা রোগ কি?
রাতকানা হল একটা রোগ যাতে রাতে বা স্বল্প আলোতে দৃষ্টিশক্তির অবনতি হয়। এই রোগে অপেক্ষাকৃত স্বল্প আলোয় দেখা কঠিন বা প্রায় অসম্ভব। এটা আসলে কতিপয় চোখের রোগের উপসর্গ। কারো ক্ষেত্রে জন্ম থেকে এই সমস্যা থাকে, এছাড়া চোখে আঘাত বা অপুষ্টির কারণে (যেমন ভিটামিন এ এর অভাব) এই সমস্যা হতে পারে। রাতকানা রোগে স্বল্প আলো বা অন্ধকারে চোখের অভিযোজন ক্ষমতা হ্রাস পায় বা নষ্ট হয়ে যায়।

রেটিনায় রড কোষ ও কোন কোষ নামে দুই ধরনের কোষ আছে যা যথাক্রমে স্বল্প ও উজ্জ্বল আলোতে কাজ করে। রড কোষে রোডপসিন নামক এক ধরনের রিসেপ্টর প্রোটিন থাকে। রোডপসিনের ওপর আলো পড়লে কয়েক ধাপে এর কিছু গাঠনিক পরিবর্তন হওয়ার মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সঙ্কেত সৃষ্টি হয় যা অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। আলোর অনুপস্থিতিতে রোডপসিন পুনরুৎপত্তি লাভ করে। রোডপসিন সংশ্লেষণে ভিটামিন এ প্রয়োজন, এজন্য এই ভিটামিনের অভাবে রাতকানা রোগ হয়।

রাতকানা রোগ এর প্রধান কারণগুলি কি কি?
রাতকানার প্রধান কারণ রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা নামক একটি রোগ, যার ফলে রেটিনার রড কোষ ধীরে ধীরে আলোর প্রতি সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এটা একধরনের জেনেটিক রোগ যেখানে রাত্রিকালীন দৃষ্টির পাশাপাশি দিনের বেলা দেখার ক্ষমতাও নষ্ট হতে থাকে। রাত্রিকালীন অন্ধত্বের ফলে জন্ম থেকে রড কোষ জন্মের পর থেকেই কাজ করে না, বা অল্প পরিমাণ কাহ করে, কিন্তু এই অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।

রাতকানা রোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো রেটিনল বা ভিটামিন এ-এর অভাব। ভিটামিন এ মাছের তেল, কলিজা ও বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবারে পাওয়া যায়। ডায়রিয়া, হাম, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগের কারণে শরীরে ভিটামিনের অভাব দেখা দেয়। এই ভিটামিনের অভাবে রাতকানা রোগ হয়। বাচ্চা জন্মকালীন ওজন কম হলে, বাড়ন্ত বয়সে শরীরে অতিরিক্ত খাদের চাহিদা পূরণ না হলে এবং অপুষ্টিতে ভোগার ফলে এই রোগ হয়ে থাকে।

বিশেষ ঔষধ, যেমন ফেনোথায়াজিন গ্রহণের ফলেও রাতকানা রোগ হতে পারে। চোখের বিভিন্ন চিকিৎসা, যেমন ল্যাসিক, ফটোরেফ্রেক্টিভ কেরাটেক্টমি, র‍্যাডিয়াল কেরাটোটমির কারণেও রাত্রিকালীন দৃষ্টি হ্রাস পেতে পারে।

বাংলাদেশ-ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে, ভিটামিন এর অভাব খুব সহজেই দেখা যায় যার কারণ হল অপুষ্টি, এবং তারসাথে সঠিকভাবে পোষকপদার্থ শরীরে শোষিত না হওয়া। এরকমই আরেকটি সমস্যা, যা ভিটামিন এর অভাবের কারণে হয় না, সেটি হল রেটিনিটিস পিগমেন্টোসা, এটি একটি বংশগত রাতকানা রোগ যা জিনগত ত্রুটির কারণে হয়।

রাতকানা রোগ এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
চিকিৎসাগত লক্ষণ ও উপসর্গগুলি হল হালকা আলোতে দুর্বল দৃষ্টিশক্তি, রাতে ড্রাইভিং করার সময় অসুবিধা এবং লঘু পরিমাণে চোখের অস্বস্তি দেখা দেওয়া। প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল অন্ধকারে চোখে খুব বেশী সমস্যা হওয়া কম মাত্রায় রেটিনাল সিরাম সঞ্চারের কারণে (1.0 মাইক্রোমোল/লিটার এর নীচে) এবং বিটটের দাগ। এই দাগ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় ভিটামিন এর অভাবে এবং চোখের পাশে (বাইরে) কোণাকৃতি, শুষ্ক, সাদাটে ফেনাবিশিষ্ট ক্ষত সৃষ্টি দ্বারা এর বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পায়। প্রথমে ভোরে ও সন্ধ্যায় অল্প আলোতে দেখতে অসুবিধে হয়, একে রাতকানা বলে৷ পরে তার চোখ শুকিয়ে যায় (জেরোসিস), চোখের সাদা অংশের চকচকে ভাবটা চলে গিয়ে সেটা কুঁচকিয়ে যায়৷ চোখে ছোট ছোট ছাই রঙের বুদবুদ ভর্তি দাগ (বিটট্স স্পট) দেখা দেয়৷ এরপর চোখের কর্নিয়া নরম হয়ে যায়৷ কর্নিয়াতে ঘা হয়৷ কর্নিয়া ঘোলাটে হয়ে যায়৷ নরম কর্নিয়া ঠেলে ফোঁড়ার মতো বেরিয়ে আসতে পারে বা ফুটো হয়ে যেতে পারে৷ অবশেষে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়৷

কিভাবে রাতকানা রোগ নির্ণয় করা হয়?
রাতকানা রোগ নির্ণয় করা হয় চিকিৎসাগত পদ্ধতি ও চিকিৎসাগত পূর্ব ইতিহাস জানা এবং তার থেকে ভিটামিন এ সিরামের কম মাত্রায় উপস্থিতি প্রমাণের মাধ্যমে, বিটটের দাগ ও ইলেক্ট্রোরেটিনোগ্রাফীর অস্বাভাবিক ফলাফল রডের কার্যকারিতা কমে যাওয়াকে প্রমান করে।

রাতকানা রোগ এর চিকিৎসা কি?
২,০০,০০০ আইইউ ভিটামিন এ তিনদিন সেবনের মাধ্যমে, ও তারপর ৫০,০০০ আইইউ ভিটামিন এ পরবর্তী ১৪ দিন অথবা ১-৪ সপ্তাহ পর পর্যায়ক্রমে একটি বাড়তি ডোজ নেওয়ার মাধ্যমে এই রাতকানা রোগের চিকিৎসা করা ও রোগটির সম্পূর্ণ নিরাময় করা হয়। তবে এক বছরের কম বয়সী শিশুরা একই নিয়মে অর্ধেক ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাবে অর্থাৎ প্রতিবারে চার ফোঁটা৷ কারণ একটি ক্যাপসুলে মোট আট ফোঁটা ওষুধ থাকে৷ প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাদ্যের বেশিরভাগ উৎস উদ্ভিতজাত, যেমন লালশাক, গাজর, বেল পেপারস, ক্যাপসিকাম, লেবুজাতীয় ফল, পাকা পেঁপে, আম, এবং অন্যান্য লাল-হলদে রঙের ফল ও শাকসবজি। প্রাণীজ উৎসগুলি হল, ডিম ও মাখন, যেগুলি হল ভিটামিন এ সমৃদ্ধ। যারা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ওষুধ সেবন সহ্য করতে পারেন না, তাদের জন্য পেশীতে ভিটামিন এ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যেহেতু ভিটামিন এর অভাব হল একটি পদ্ধতিগত রোগ, তাই চোখের ড্রপ ব্যবহারে কোন সুফল পাওয়া যায় না।

রাতকানা প্রতিরোধে কি ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা যায়?
একটু সতর্ক ও সচেতন থাকলেই রাতকানা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
প্রতিরোধ:

  • বাচ্চাকে প্রথম ৫ মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে৷ বুকের দুধ শিশুকে রাতকানা হওয়া থেকে রক্ষা করে৷ বুকের দুধ সম্ভব হলে শিশুর দুই বছর বয়স পর্যন্ত খাওয়াতে হবে৷
  • বাচ্চা হবার দুই সপ্তাহ পর মাকে ২ লক্ষ আই.ইউ. ভিটামিন-এ এর ১ ডোজ খাওয়াতে হবে৷
  • শিশুকে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার (হলুদ ফলমূল ও শাক-সবজি, ডিম/দুধ/কলিজা, মাছ, মাংস,) খাওয়াতে হবে৷
  • ৬ মাস বয়স থেকে শুরু করে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি ৬ মাস অন্তর উচ্চ মাত্রার ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে৷
  • অপুষ্টি রোধ করতে হবে৷
  • বাচ্চা অপুষ্টিতে ভুগলে, হাম, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার পাশাপাশি ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে৷
  • চোখের কালো অংশে কোনও পরিবর্তন (যেমন- ধোঁয়াটে, ঘোলা, ছিদ্র, সাদা হওয়া) দেখা দিলে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে৷


পরামর্শ:
প্রতিদিন ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে যেমন-

  • গার সবুজ শাক যেমন- কচু-শাক, পুঁইশাক, পালংশাক, মূলা-শাক ইত্যাদি৷
  • হলুদ সবজি যেমন- মিষ্টি কুমড়া, গাজর ইত্যাদি৷
  • হলুদ ফল যেমন- পাকা কাঁঠাল, পাকা আম, পাকা পেঁপে ইত্যাদি৷
  • প্রাণী জাতীয় খাদ্য বা প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমন- দুধ, ডিমের কুসুম, কলিজা, ছোট মাছ ইত্যাদি৷


শাক-সবজি অবশ্যই তেল দিয়ে রান্না করতে হবে৷ তেল দিয়ে রান্না করে খেলে ভিটামিন-এ বেশি পাওয়া যায়৷ এ ছাড়া ৬ মাস বয়স থেকে শুরু করে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত সকল শিশুকে ৬ মাস পর পর একটি করে ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে৷ ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর মাত্রা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিকভাবে অবশ্যই মেনে চলতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খেতে দেয়া বিপদজনক৷ এতে করে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে৷

বাড়ির আঙিনায় শাক-সবজির চাষ:
যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই দরিদ্র৷ তাই স্বাভাবিক কারণেই ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ বেশি দামের খাদ্য যেমন- মাছ, কলিজা, দুধ ডিম, পনির, মাখন প্রভৃতি কিনতে পারে না৷ ভিটামিন-এ যুক্ত শাক-সবজি বাড়ির আঙিনায় জমিতে চাষ করলে সহজে ভিটামিন-এ এর চাহিদা মেটানো যায়৷

বুকের দুধ খাওয়ানোর অভ্যাস:
শিশুর জন্মের পর মায়ের শাল দুধ খাওয়াতে হবে৷ কারণ শাল দুধে অধিক মাত্রায় ভিটামিন- এ থাকে৷


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে