প্রতিটি প্রসববেদনা এবং জন্ম একটি অপরটি থেকে আলাদা এবং কখন শুরু হয় এবং কতক্ষণ সময় লাগে তার উপর ভিত্তি করে এর তারতম্য ঘটে।প্রসবের তিনটি প্রধান পর্যায় আছে। প্রতিটি পর্যায়ের জন্য কতো সময় লাগবে তা প্রতিটি মহিলার জন্য ভিন্ন হয়। অধিকাংশ মহিলা প্রসবের শুরুতে এসব উপসর্গগুলোরমধ্যে এক বা একাধিক অনুভব করেন:
প্রসবের প্রথম পর্যায়ের শুরুর দিকে আপনার জরায়ু, যোনীমুখকে পাতলা এবং সংকোচিত করার জন্য কাজ করে। প্রথম প্রসবের ক্ষেত্রে যোনীমুখের এই সংকোচন এবং পাতলা করার কাজটি কঠিন হতে পারে এবং আপনাকে পরিশ্রান্ত করতে পারে, কাজেই যখন পারবেন তখনই বিশ্রাম নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়া কয়েকদিন সময় নিতে পারে।
প্রথম পর্যায় যখন অগ্রসর হতে থাকে তখন আপনার জরায়ু, যোনীমুখ (গর্ভাশয়ের গলা) খোলার জন্য সংকোচন করতে থাকে। এই সংকোচনগুলো বাড়তে থাকে যতক্ষণ না যোনীমুখ ১০ সে.মি. পর্যন্ত খোলে, যা বাচ্চা বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
গড়ে, প্রথম বাচ্চার ক্ষেত্রে এই প্রথম পর্যায় ১০-১৪ ঘন্টা স্থায়ী হয় এবং দ্বিতীয় বাচ্চার ক্ষেত্রে ৮ ঘন্টার মতো স্থায়ী হয়।
মহিলারা বিভিন্নভাবে সংকোচনকে অনুভব এবং বর্ণনা করে থাকেন। এগুলো অনুভূত হতে পারে:
শুরুর দিকে এই সংকোচনগুলো সংক্ষিপ্ত এবং অনেক পর পর হয় – কখনো কখনো তা ৩০ মিনিট অন্তর হতে পারে। কিন্তু তা ক্রমশই জোরালো, দীর্ঘ এবং কাছাকাছি সময়ে হতে থাকে। ধীরে ধীরে সংকোচনগুলো পরস্পর কাছাকাছি হবে, আরো বেশী বেদনাদায়ক এবং দীর্ঘ সময় জুড়ে হবে, যতক্ষণ না এগুলো প্রায় এক মিনিট জুড়ে হবে এবং দ্রুত হবে – প্রতি দুই অথবা তিন মিনিট অন্তর অন্তর হবে।
যখন সংকোচনগুলো শক্তিশালী এবং কাছাকাছি সময়ে হতে থাকবে, আপনি উদ্বিগ্ন, এমনকি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যেতে পারেন। এই ক্ষেত্রে সংকোচনের শুরুতে গভীর শ্বাস নেয়া, তারপর ছন্দের সাথে শ্বাস নেয়া এবং শ্বাস ত্যাগের দিকে মনোযোগ দেয়াটা সাহায্য করে।
দীর্ঘশ্বাস বা গোঙ্গানী বা ছন্দের সাথে শব্দ করাও সাহায্য করতে পারে। এক সময়ে প্রতিটি সংকোচনের উপর মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করুন। যখন সংকোচনটি শেষ হবে তখন গভীর শ্বাস টানুন এবং জোরে বের করে দিন। এটি দুই সংকোচনের মাঝখানে আপনাকে শান্ত হতে সাহায্য করে।
অনেক মহিলা বলেন যে, হাঁটাহাঁটি করা বা কোন সুবিধাজনক অবস্থান বেছে নেয়া সংকোচনের সময় সাহায্য করে থাকে – সংকোচনের সময় যেটা হতে পারে কোন কিছুতে হেলান দেয়া বা কোমর দোলানো অথবা চার হাত-পা উবু হয়ে দোলানো।
একটু সময় নিয়ে গোসল প্রসববেদনা কমাতে এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আসলেই সাহায্য করতে পারে। আপনি যতোই প্রসবের দিকে অগ্রসর হতে থাকবেন আপনার ধাত্রী আপনাকে সাহায্য করার জন্য অনেক উপায় বলবেন কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, কিভাবে নড়াচড়া করবেন এবং শ্বাস নিবেন তা আপনার শরীরই বলে দিবে।
আপনি রক্ত মিশ্রিত বা গোলাপী রঙ্গের শ্লেষ্মাও বের করতে পারেন। এটি হচ্ছে একটি ছিপি বা পর্দা যা আপনার জরায়ু মুখকে বন্ধ রেখেছিল। এর মানে আপনার জরায়ু মুখের প্রসারণ শুরু হয়েছে। সংকোচনের কয়েক ঘন্টা বা এমনকি কয়েকদিন পূর্বে একটি প্রদর্শন দেখা যেতে পারে।
‘পানি ভাঙ্গা’ মানে হচ্ছে, যে ব্যাগ বা গর্ভথলিতে আপনার শিশু থাকে তা ফেটে যাওয়া এবং গর্ভথলির রস বের হয়ে আসা। যে তরলটি বের হয়ে আসে তা হচ্ছে গর্ভথলির রস যা আপনারত শিশুকে আপনার ভিতরে বেড়ে উঠার সময় ঘিরে রাখে এবং সুরক্ষা প্রদান করে। তরলটি সাধারণত স্বচ্ছ হয়, কিন্তু তা হলুদ বা খড়ের মত রঙ হতে পারে।
এটি যদি সবুজ বা লাল রংয়ের হয় তাহলে কোন জটিলতা থাকতে পারে। রং যাই হোক না কেন আপনি একটি প্যাড লাগান এবং আপনার ধাত্রী বা মাতৃত্ব ইউনিট বা ডাক্তারকে ফোন করুন, কারণ সম্ভবত আপনাকে জন্মদান কেন্দ্র বা হাসপাতালে যেতে হতে পারে যেখানে তারা আপনাকে, আপনার বাচ্চা এবং আপনার বাচ্চার অবস্থানের পরীক্ষা করতে পারে।
যদি আপনার পানি ভেঙ্গে যায় এবং ২৪ ঘন্টা পরও আপনার সংকোচনগুলো নিয়মিত না হয় তাহলে আপনার প্রসব আবেশন (প্রসব ব্যাথা উঠানো বা ইন্ডাকশন) করার প্রয়োজন হতে পারে, কারণ তখন সংক্রমনের ঝুঁকি থাকে। আপনার ধাত্রী বা ডাক্তার এই ব্যাপারে আপনার সাথে আলাপ করবেন।
কখনো কখনো, আপনার ডাক্তার প্রসব আবেশনের সুপারিশ করতে পারে- প্রাকৃতিকভাবে প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার অপেক্ষায় না থেকে কৃত্রিমভাবে শুরু করা হয়। একটি বাচ্চাকে ইনডাকশন করার কারণগুলো হলো বহুগর্ভ বা গর্ভে যমজ বাচ্চা, বহুমূত্র রোগ বা ডায়াবেটিস, কিডনী সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ বা যখন গর্ভাবস্থা ৪১ সপ্তাহ অতিক্রম করে।
যদি আপনার প্রসব ইনডাকশন করা হয় তাহলে এটা আপনার ডাক্তার বা ধাত্রীর সাথে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। ইনডাকশন করার সুবিধা অবশ্যই ঝুঁকির চেয়ে বেশী হতে হবে। প্রসব ইনডাকশনের কিছু ঝুঁকি থাকে, উদাহরণস্বরূপ – ফোরসেপ বা ভ্যাকুয়াম প্রসবের এবং সিজারিয়ান অপারেশনের উচ্চ ঝুঁকি থাকে।
পর্দা ছিঁড়ে দেয়া একটি সাধারণ পদ্ধতি। যোনীপথে পরীক্ষা করার সময়, ধাত্রী বা ডাক্তার পর্দাকে প্রসব প্রক্রিয়ার জন্য তৈরী করতে আঙ্গুল দিয়ে বৃত্তাকারভাবে নড়াচড়া করায়। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে পর্দার এই নড়াচড়া প্রসব শুরু হওয়াকে উন্নীত করে এবং অন্যান্য ইনডাকশন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা কমায়।
প্রোষ্টাগ্লানডিন একটি হরমোন যা আপনার শরীর তৈরী করে। এটি আপনার জরায়ুর মুখ নরম হতে সাহায্য করে। Prostin ও Cirvidil হলো দুটি সিনথেটিক প্রোষ্টাগ্লানডিন। জরায়ুর মুখকে নরম করতে জরায়ুর মুখের কাছে যোনীপথে এগুলোকে প্রবেশ করানো হয়। এটি সংকোচন শুরু করতে পারে। প্রভাব শুরু করতে তারা ৬-১৮ ঘন্টা সময় নেয়। একটি ঝুঁকি হলো এই ইনডাকশন পদ্ধতি আপনার জরায়ুকে অধিক উদ্দীপনা দেয় এবং বাচ্চার জন্য সমস্যা তৈরী করে।
যান্ত্রিকভাবে জরায়ুর মুখ প্রস্তুত করানো প্রক্রিয়ায় একটি ছোট প্লাষ্টিক ক্যাথেটার ব্যবহার করা হয়, জরায়ুর মুখকে নরম এবং খোলার জন্য।
পানি ভাঙ্গানো (গর্ভবরণ কর্তন/ছেদন (অ্যামনিওটমি) বলে)- তে একজন ডাক্তার বা ধাত্রী যোনীপথে একটি যন্ত্র প্রবেশ করায় এবং জরায়ুর মুখের খোলা জায়গা দিয়ে গর্ভফুলের রস ধরে রাখা পর্দাতে মৃদুভাবে খোঁচা দেয়। এটি বাচ্চার মাথাকে জরায়ুর মুখের দিকে বেশী নামতে সাহায্য করে, হরমোন এবং সংকোচন বাড়ায়।
অক্সিটোসিন একটি হরমোন যা আপনার শরীর প্রসবের সময় প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন করে। এটি জরায়ু সংকোচন করে। সিনথেটিক অক্সিটোসিন শিরাপথে ফোটায় ফোটায় দিলে তা সংকোচন শুরু করতে সাহায্য করে।
অক্সিটোসিন- এর খারাপ দিক হলো এটি শক্তভাবে সংকোচন করে যা মানিয়ে নেয়া কষ্টকর। তার মানে আপনার ব্যাথা নিরামক লাগতে পারে। অক্সিটোসিনের ঝুঁকি প্রোস্টাগ্লান্ডিনের মতোই, শুধু এর প্রভাব সুস্পষ্ট এবং তাড়াতাড়ি হয়, কিন্তু প্রোষ্টাগ্লান্ডিনের চেয়ে আরো বেশী পরিবর্তন যোগ্য।
এই মেডিকেল হস্তক্ষেপগুলোর সমন্বয় প্রসব শুরু করার জন্য প্রয়োজন হতে পারে।
এটা প্রথম ধাপের শেষের দিকে পরিবর্তনের সময়। আপনার জরায়ুর মুখ এখন সম্পূর্ণ খোলা, শীঘ্রই বাচ্চা যোনীপথের দিকে নামতে শুরু করবে। কিছু মহিলা বলে যে এটি প্রসবের কঠিনতম অংশ। শক্তিশালী সংকোচন ৬০-৯০ সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং ১-২ মিনিট পর পর আসে। আপনি অনুভব করবেন:
এগুলো সব স্বাভাবিক অনুভূতি, কিন্তু আপনার এসব উপসর্গের কোনটিরই অভিজ্ঞতা নাও হতে পারে।
ট্রাঞ্জিশন বা পরিবর্তন ৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টার উপর সময় নেয়।
জরায়ুর মুখ সম্পূর্ণভাবে খোলা থেকে শিশু সম্পর্ণ ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত সময় বা অবস্থাকে প্রসবের দ্বিতীয় পর্যায় ধরা হয়৷ এই সময় পানির থলি ফেটে যায় এবং শিশু জরায়ু থেকে প্রসব পথে ভূমিষ্ট হয়৷
দ্বিতীয় পর্যায়ে, বাচ্চা বের করার জন্য আপনাকে ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করতে হবে। বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজনের মতো আপনার প্রবলভাবে ইচ্ছা হবে ধাক্কা দেয়ার। বাচ্চার মাথা যোনীপথে আসার পর একটি প্রসারিত, জ্বালাপোড়া ভাব অনুভূত হয়।
সাধারণত দ্বিতীয় পর্যায়, প্রথম প্রসবের সময় ২ ঘন্টা ব্যাপী এবং দ্বিতীয় প্রসবের সময় ১ ঘন্টা ব্যাপী থাকে, কিন্তু এপিডুরাল এই পর্যায়কে দীর্ঘ করতে পারে।
মাঝে মাঝে ফোরসেপ অথবা ভ্যাকুয়াম নিষ্কাশনের মাধ্যমে বাচ্চাকে প্রসব করানো লাগে। এর কারণ:
যন্ত্রের সাহায্যে প্রসবের দুইটি পদ্ধতি আছে:
ফোরসেপ বা চিমটা আংটার মতো যা বাচ্চার মাথার চারপাশে আটকে থাকে। এটা যোনীপথ থেকে বাচ্চাকে বের করতে সাহায্য করে। যদি আপনার চিমটার সাহায্যে প্রসব করানোর প্রয়োজন হয়, তবে সাধারণত এপিশিয়োটমির প্রয়োজন হবে। এপিশিয়োটমি হচ্ছে মহিলাদের নিম্নাঙ্গ (যোনীপথও মলদ্বারের মধ্যবর্তী জায়গা) অস্ত্রোপচারের দ্বারা কাঁটা।
জন্মের সময়, বাচ্চার মাথা নিম্নাঙ্গ দিয়ে যাওয়ার সময় নিম্নদেশ ছিঁড়ে যেতে পারে। যখন চিমটা বা ফোরসেপ ব্যবহার করা হয় তখন এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। গবেষণায় দেখা গেছে, উপযুক্ত এপিসিওটমি ব্যবহার যোনীপথ অথবা নিম্নাঙ্গ ছেঁড়া হ্রাস করে। ফোরসেপ দিয়ে জন্মগ্রহণ করানোতে নিম্নাঙ্গ বেশী ছিঁড়ে যায়। যেসব মহিলাদের এপিশিয়োটমি অথবা মাংসপেশী ছিঁড়ে যায় তাদের সেলাই প্রয়োজন। প্রসবের পূর্বে আপনার ধাত্রী বা ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
চোষণ/ভ্যাকুয়ামযন্ত্রের মাধ্যমে প্রসব (ভেন্টোজ) পাম্পের সাথে যুক্ত কাপের মতো একটি যন্ত্র। কাপটি যোনীপথে বাচ্চার মাথায় স্থাপন করা হয়। পাম্প শূণ্যস্থান তৈরী করে। এটি বাচ্চার মাথাকে কাপে ধরে রাখে যা ডাক্তারকে বাচ্চা আলতোভাবে বের করতে সাহায্য করে,সাধারণত যখন আপনার সংকোচন হয় এবং আপনি ধাক্কা দেন।
জন্মের সময় কি হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে আপনার ডাক্তার পদ্ধতি নির্ণয় করবেন – মাঝে মাঝে চিমটা ভালো এবং অন্য সময় ভ্যাকুয়াম নিষ্কাশন পদ্ধতি ভালো। এই ক্ষেত্রে কোন কিছু পরিকল্পনা করে করার চেয়ে সময়ানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এসকল পদ্ধতি ব্যবহারের পূর্বে কি হবে এবং এর কোন সম্ভাব্য পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আপনার ডাক্তার বা ধাত্রী আপনাকে ব্যাখ্যা করবেন।
প্রসবের তৃতীয় এবং শেষ পর্যায় শুরু হয় বাচ্চার জন্মের পর থেকে এবং স্থায়ী হয় জরায়ু গর্ভফুল বের করা পর্যন্ত । এই পর্যায় সাধারণত ছোট হয় এবং অন্য দুইটি থেকে কম ব্যাথাযুক্ত। তদুপরি, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায় এবং দ্রুত শেষ করতে হয়।
বেশীর ভাগ মহিলাদের গর্ভফুল/প্লাসেন্টা দ্রুত বের করার জন্য সিনথেটিক অক্সিটোসিন দেয়া হয়। এটিকে বলা হয় সক্রিয় ব্যবস্থাপনা এবং গর্ভপরবর্তী রক্তপাত বন্ধের উত্তম উপায়। ইনজেকশান দেয়ার পর ৫-১০ মিনিট সময় লাগে।
কিছু মহিলা অপেক্ষা করতে পছন্দ করে এবং গর্ভফুলকে ইনজেকশান ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে বের করা পছন্দ করে (একে প্রাকৃতিক তৃতীয় পর্যায় বলে)। প্রাকৃতিক তৃতীয় পর্যায় এক ঘন্টা বা তার বেশী সময় নেয়। কোনটি আপনার জন্য সর্বোত্তম উপায় তা নিয়ে আপনার ধাত্রী বা ডাক্তারের সাথে কথা বলুন । এটি আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
সবার জন্য শুভকামনা