ইয়ং বেঙ্গল ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ সা্পর্কে শিক্ষিত সমাজের প্রায় সবাই কিছু না কিছু ধারনা আছে। ইয়ং বেঙ্গল ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের গোড়াপত্তন নিয়ে গুরুত্বপূর্ন  তথ্য বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করব।

ইয়ং বেঙ্গলঃ ইয় বেঙ্গল হচ্ছে ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও ভাব মিষ্যের দ্বারা পরিচালিত একটি আন্দোলন। ইয়ং বেঙ্গলরা সমাজে প্রচরিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামাজিক শৃঙ্খল মুক্তির প্রয়াস চালাত। তারা ব্যাপকভাবে পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শন ও জীবনপ্রবাহে আকৃষ্ট ছিলেন্। তারা সবকিছু যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার পক্ষপাতী ছিলেন। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের প্রবক্তা হেনরি লুই ভিাভিয়ান ডিরোজিও। তবে তিনি ডিরোজিও নামেই সমাধিক পরিচিত। ইয়ং বেঙ্গলের নীতি ছিল, ’সত্যের জন্য বাঁচা, সত্যের জন্য মরা’।

মুসরিম সাহিত্য সমাজঃ ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম সংগঠন হচ্ছে মুসলিম সাহিত্য সমাজ। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সংগঠকরা সবাই ছিলেন মুক্তবুদ্দি ও প্রগতশীল চিন্তা-চেতনার অংশীদার। তাঁরা সাহিত্য, সংস্কৃতি, ললিতকলা প্রভৃতি চর্চার মাধ্যমে বাঙালি সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন, বিশেষ করে মুস্রলমান সম্প্রদায়কে। তাঁরা অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় গোড়ামির ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁরা পত্র-পত্রিকা প্রকাশ, গ্রন্থরচনা ও সভা-সেমিনারের মাধ্যমে তাদের চিন্তা বাঙালি সমাজের কাছে পৌছে দিতে চেয়েছিলেন। এ সংগঠনের অন্যতম ব্যক্তি হচ্ছেন আবুল হুসেন।

ইয়ং বেঙ্গল ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্ভবঃ ইয়ং বেঙ্গল ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের মতো প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি আলাদা দুটি শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হলেও এদের জন্ম ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইয়ং বেঙ্গল প্রতিস্ঠা হওয়ার পরেও বিংশ শতাব্দীতে কেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের জন্ম হলো তার রয়েছে এক বিস্তৃত ইতিহাস।

মুসলমানদের আগমনের পূর্বে প্রাচীন ভারতে হিন্দু ও বৌদ্ব ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস ছিল। সে সময় টোল, চতুষ্পাঠীতে বিভিন্ন প্রকার শি্ষোরর ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ করে ব্যাকরণ, দর্শন, সাহিত্য ও ধর্মীয় শিক্ষা ছিল প্রধান। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা জয়ের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। পরবর্তীতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের পণ্ডিতেরা জ্ঞানচর্চার নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের পূর্বে এখানে শিক্ষার প্রধান মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। পরে তিনি সমগ্র উত্তর বাংলা অধিকার করেন। ফরে অধিকাংশ জনগণ বিশেষত পূর্ববাংলার জনগণ ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত হন। ধীরে ধীরে সংস্কৃতের গুরুত্ব কমতে থাকে এবং রাজদরবারের ভাষা হওয়ায় ফারসির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। সরকারি চাকরি লাভের আশায় ও দৈনন্দিন প্রয়োজনে হিন্দুরাও ফারসি ভাষা শিক্ষা করে। মুসলমান শাসন আমলে ব্যবসায় ও মহাজনী কারবারে হিন্দুগণ অধিকতর নিযুক্ত ছিলেন্। প্রকৃতপক্ষে ১২০৩ থেকে ১৮৩৫ সাল প্রায় ছয়শত বছরেরও অধিকালব্যাপী ফারসি ছিল বাংলার রাষ্ট্রভাষা। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলো ফারসির পাশাপাশি ধর্মীয় কারণে আরবি ও উর্দু ভাষাও শিক্ষা করত। ১৯৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে নবাবের পরাজয় হয়। আটঘন্টাব্যাপী এ যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শুধু একটি যুগের অবসান নয়, ভারতের স্বাধীনতার স্তম্ভও অস্তমিত হয়। ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসে বাণিজ্য করার জন্য। এ উদ্দেশ্যে তারা একটি বণিক সংঘ গড়ে তোলে। এ বণিক সংঘের নাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এ বণিক সংঘটি ১৬০০ সালে রানি এলিজাবেথের নিকট থেকে প্রাচ্যে ১৫ বছর একচেটিয়া বাণিজ্য করার অনুমতি লাভ করে। এরপর ক্যাপ্টেন হকিন্স ১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার অনুমতি নিয়ে সুরাটে ১৬১২ সালে প্রথম বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করেন। ১৬৯০ সালে জব চার্ণক সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা ক্রয় করে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করেন। জব চার্ণক ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী এ তিনটি গ্রাম ক্রয় করেছিলেন ১২০০ টাকায়। পরবর্তীতে এ তিনটি গ্রামকে কেন্দ্র করে কলকাতা নগরীর জন্ম হয়। এখানেই কোম্পানি ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নাম অনুসারে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করেন। ১৮০০ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলি এ দুর্গে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। 

১৭১৭ সালে কোম্পানি সম্রাট ফররুখ শিয়রের কাছ থেকে বিনা শুল্কে বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি লাভ  করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে কোম্পানি সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়।  ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসেমকে পরাজিত করে এবং সম্রাট শাহ আলমের কাছে বাংলার রাজস্ব আদায়ের দেওয়ানী লাভ করে কোম্পানী। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের নামে গ্রামে গ্রামে চলে অবাধ লুটপাট। এ লুটপাটেরই ফসল ১১৭৬ এর দুর্ভিক্ষ। ১৭৭২ সালে দ্বৈত শাসনের অবসান হয় ও মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত করে। ১৭৮০ সালে এখানে (কলকাতায়) কলিকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আদালতে ফারসি ভাষা চালু থাকায় বিচার বিভাগে অনেকে চাকুরিতে নিযুক্ত হন।কলিকাতা মাদ্রাসায় ফারসিতে মুসড়মান অাইন শিক্ষা দেওয়া হতো। ফলে বিচার বিভাগে মুসলমানরা একচেটিয়া অাধিপত্য করত। মুসলমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এখানে ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। ১৭৮৯ সালে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটে। ফলে কাঁচামাল সয়গ্রহ ও পণৌ বিক্রয়ের জন্য বাজার সৃষ্টি করা কোমবপানির জন্য অাবশ্যক ছিল। তাই তারা ভারতের মত বিরাট উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করে। একশালা, পাঁচশালা,  দশশালা এবং পরিশেষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) পদ্ধতি চালু করে ভূমি সংস্কার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে ভূমি ও প্রজার উপর জমিদারদের মালিকানা স্থাপিত হয়। নির্ধারিত কর প্রদানের মাধ্যমে জমিদারগণ বংশ পরস্পরায় জমিদারি করার সুযোগ পায়। কিন্তু এর সাথে সূর্যাস্ত আইন চালু করা হয়। ফলে বিত্তশালীরা জমিদারি নিলামে কিনে নিতেন। এতে হিন্দু-মুসলমান দুই শ্রেণির জমিদারগণক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পিছনে শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল অভিজাত মুসলমান সম্প্রদায়ের ধ্বংস সাধন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সহযোগী একটি নতুন শ্রেণী তৈরি করা। এজন্য তারা মুসলমান আমলের শহর পরিত্যাগ করে এবং কলকাতার মত অনুন্নত জায়গায় নগর তৈরি করে। যারা জমিদারী কিনতেন তারা কোম্পানীর দেওয়ানী, বেনিয়াগিরী, দালালী, মুৎসাদ্দিগিরী, মহাজনী ইত্যাদী করে টাকা উপার্হন করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এ শ্রেণি হিন্দু সমাজের লোক এবং পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা ও এর আশেপাশে এদের বাস ছিল। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল। মুসলমানদের অধিকাংশ ছিল কৃষিজীবী, চাকুরীজীবী ছিল খুব কম। শিক্ষার ক্ষেত্রে কৃষক সমাজের অাগ্রহ কম থাকাই স্বাভাবিক।

১৮০০ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য ১৬-২০ বছর বয়সী স্বল্পশিক্ষিত ইংরেজ তরুণ কর্মচারীদের কোম্পানির প্রশাসনিক প্রয়োজনে এ দেশের ভাষা, আচার ব্যবহার ও ধর্মীয় রীতি নীতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। বিধান রাখা হয় ভারতীয়রাও এ কলেজে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে। ইংরেজি শিক্ষক এর পাশাপাশি এ কলেজে শিক্ষাদান ও গ্রন্থ প্রণয়নের সুযোগ পেলেন বাঙালি পণ্ডিত ও শিক্ষকরা। তাঁদের হাতেই বিকাশ লাভ করে বাংলা গদ্য যা বাঙালির অাধুনিক মন ও মনন, বিদ্যা ও বুদ্ধি,  চিন্তা ও চেতনা বিকাশের অন্যতম বাহন। উল্লেখ্য ১৭৭৮ সালে শ্রিরামপুরেপ্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ১৮০১-১৮১৫ সালে ৮ জন লেখক ১৩ খানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এ আটজনের মধ্যে একমাত্র উইলিয়াম কেরি-ই ভিনদেশি, বাকি সবাই ভারতের এবং হিন্দু।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে